রাঙামাটি । শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ , ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১৬:২৪, ৭ মে ২০২০

শ্রদ্ধায় স্মরণ

রবীন্দ্রনাথের পত্রসাহিত্য

রবীন্দ্রনাথের পত্রসাহিত্য

ফাইল ফটো


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কে তিনি? জবাবে এক বাক্যে বাঙালি বলবে- বিশ্বকবি। উইকিপিডিয়া বলে- বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী, দার্শনিক...।

হালের নির্দেশক গুগলের খোঁজে মেলে আরো অনেক পরিচয়। আবার কবি/সাহিত্যিকরা মনের মাধুরী মিশিয়ে নতুন নতুন বিশেষণ দিয়েই যাচ্ছেন যুগ যুগ ধরে। কোনোটিই অতিরিক্ত নয়। সবগুলোই ঠিক-ঠাক মানিয়ে যায়। অর্থাৎ তিনি সকল পরিচয় ছাড়িয়ে আটকে গেছেন কেবলই নিজের নামে। সেই কবেই তো শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখে গিয়েছেন, ‘কবিগুরু তোমার প্রতি চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের সীমা নাই।’ অর্থাৎ রবীন্দ্র-প্রতিভা বঙ্গে এক পরম বিস্ময়। কোন শাখায় নেই তার পদচারণা? অন্যরা যে বিষয়গুলো চিন্তায় আনতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই বিষয়েও মেখে দিয়েছেন সাহিত্যের রস। করে তুলেছেন আলচ্য বিষয়। এর অন্যতম উদাহরণ পত্রসাহিত্য। 

রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের অন্যতম প্রধান অঙ্গ- কৃতি হিসেবে তার গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, কবিতা, গীতির চেয়ে কোনো অংশেই কম নয় পত্রসাহিত্য। অতি প্রাচীনকাল থেকেই যে পত্রসাহিত্যের ব্যবহার ছিল এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো করে কেউ ব্যবহার করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক পত্রসাহিত্য আজ পর্যন্ত উনিশটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ছিন্নপত্র ও ছিন্নপত্রাবলী (ভাইঝি ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীকে লেখা), ভানুসিংহের পত্রাবলী (রানু অধিকারীকে ‘মুখোপাধ্যায়’ লেখা) ও পথে ও পথের প্রান্তে (নির্মলকুমারী মহলানবিশকে লেখা) বই তিনটি তার তিনটি উল্লেখযোগ্য পত্রসংকলন। ১৮৮৭-১৮৯৫ সালে শ্রীমতী ইন্দিরা দেবীকে রবীন্দ্রনাথ যে সমস্ত পত্র লিখেছেন তা থেকে ১৫৩টি পত্র-সংকলিত হয়েছে ছিন্নপত্র। 

এ সময়ে লিখিত চিঠিপত্র (সব চিঠি নয়) ইন্দিরা দেবী দুটি খাতায় স্বহস্তে নকল করে কবিকে উপহার দিয়েছিলেন। এই খাতা দুটি অবলম্বনে, অনুলেখিকা অথবা পত্রকার স্বয়ং যতটা সঙ্কলনযোগ্য মনে করেছিলেন তাই নিয়ে ১৩১৯ সালে ছিন্নপত্র প্রকাশিত হয়। বহু চিঠিই রবীন্দ্রনাথ তখন গ্রন্থভুক্ত করেননি; অনেক পত্রের কোনো কোনো অংশ সাধারণের সমাদরযোগ্য নয় মনে করেও বর্জন করেন। মূল খাতা-দুখানি অবলম্বনে ১৯৬০ সালে ছিন্নপত্রাবলী নামে যে গ্রন্থখানি প্রকাশিত হয়।

ইন্দিরা দেবীকে লেখার বিষয়-বৈশিষ্ট্য অনুধাবনের প্রয়োজনে একটি চিঠির কিছু অংশ উল্লেখ করা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমার অনেক সময় ইচ্ছা করে, তোকে যে সমস্ত চিঠি লিখেছি সেই গুলো নিয়ে পড়তে পড়েত আমার অনেক দিনকার সঞ্চিত অনেক সকাল দুপুর সন্ধ্যার ভেতর দিয়ে আমার চিঠির সরু রাস্তা বেয়ে আমার পুরাতন পরিচিত দৃশ্যগুলির মাঝখান দিয়ে চলে যাই। কত দিন কত মুহূর্তকে আমি ধরে রাখবার চেষ্টা করেছে- সেগুলো বোধ হয় তোর চিঠির বাক্যের মধ্যে ধরা আছে। আমাকে একবার তোর চিঠিগুলি দিস- আমি কেবল ওর থেকে আমার সৌন্দর্যসম্ভোগগুলো একটা খাতায় টুকে নেব আমার গদ্যে-পদ্যে কোথাও আমার সুখ দুঃখের দিনরাত্রিগুলি এ রকম করে গাঁথা নেই (শিলাইদহ। ১১ মার্চ ১৮৯৫, সংযোজন, ছিন্নপত্র)।

ছিন্নপত্রের যে-কোনো একটি চিঠি পড়লেই দেখা যাবে কবির অনুপ্রাণিত মনে বহির্জগতের ক্রিয়াগুলি যে-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে তাকেই সত্যরূপে পত্রগুলি বিশ্বস্তভাবে ধারণ করে আছে। যেমন প্রকৃতির বক্ষলগ্ন কবির প্রাণিত অনুভব:
ওই-যে মস্ত পৃথিবীটা চুপ করে পরে রয়েছে ওটাকে এমন ভালোবাসি- ওর এই গাছপালা নদী মাঠ কোলাহল নিস্তব্ধতা প্রভাত সন্ধ্যা সমস্তটা-সুদ্ধ দুহাতে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে। মনে হয় পৃথিবীর কাছ থেকে আমরা যে-সব পৃথিবীর ধন পেয়েছি এমন কিকোনো স্বর্গ থেকে পেতুম? স্বর্গ আর কী দিত জানি নে, কিন্তু এমন কোমলতা দুর্বলতা-ময়, এমন সকরুণ আশঙ্কা-ভরা, অপরিণত এই মানুষগুলির মতো এমন আপনার ধন কোথা থেকে দিত! আমি এই পৃথিবীকে ভারী ভালোবাসি। এর মুখে ভারী একটি সুদূরব্যাপী বিষাদ লেগে আছে- যেন এর মনে আছে, আমি দেবতার মেয়ে, কিন্তু দেবতার ক্ষমতা আমার নেই। আমি ভালোবাসি, কিন্তু রক্ষা করতে পরি নে। আরম্ভ করি, সম্পূর্ণ করতে পরি নে। জন্ম দিই, মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পরি নে। এই জন্যে স্বর্গের উপর আড়ি করে আমি আমার দরিদ্র মায়ের ঘর আরো বেশি ভালোবাসি- অসহায়, অসমর্থ, অসম্পূর্ণ, ভালোবাসার সহ¯্র আশঙ্কায় সবর্দা চিন্তাকাতর বলেই। (পত্র ১৮, ছিন্নপত্র)।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কাদম্বিনী দত্তের পত্রব্যবহারও ছিল মুগ্ধকর। তিনি নানা প্রশ্ন করে এমনভাবে চিঠি লিখতেন যে, রবীন্দ্রনাথ উত্তর লিখতে উদ্বুদ্ধ হতেন। বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণকারিণী এই গরীয়সী রমণীর মুখ্য প্রশ্নটি ছিল আপনি এমন কবি ও ভাবুক হয়েও বৈষ্ণবধর্মকে কেন সমর্থন করেন নি, এবং সাকার-উপাসনার বিরুদ্ধে বলেন কেন?

এ সম্পর্কে কবি বহু পত্রে বহু কথা লিখেছেন। তার একটি অংশ এমন- আমি র্নিগুণ নিরঞ্জন নির্ব্বিশেষের সাধক এমন একটা আভাস তোমার চিঠিতে পাওয়া গেল। কোনো একদিক থেকে সেটা হয়তো সত্য হতেও পারে- যেখানে সমস্তই শূন্য সেখানেও সমস্তই পূর্ণ-যিনি তিনি আছেন এটাও উপলব্ধি না করব কেন? আবার এর উল্টো কথাটাও আমারি মনের কথা। যেখানে সব-কিছু আছে সেখানেই সবার অতীত সব হয়ে বিরাজ করেন এটাও যদি না জানি তাহলে সেও বিষম ফাঁকি। আজ এই প্রৌঢ় বসন্তের হাওয়ায় বেলফুলের গন্ধ সিঞ্চিত প্রভাতের আকাশে একটা রামকেলী রাগিণীর গান থাকে ব্যাপ্ত হয়ে- স্তব্ধ হয়ে একা একা বেড়াই যখন, তখন সেই অনাহত বীণার আলাপে মন ওঠে ভরে। এই হোলো গানের অন্তর্লীন গভীরতা। তার পরে হয়তো ঘরে এসে দেখি গান শোনবার লোক বসে আছে- তখন গান ধরি ‘প্যালা ভর ভর লায়ীরি’। সেই ধ্বনিলোকে দেহমন সুরে সুরে মুখরিত হয়ে ওঠে, যা কিছুকে সেই সুর স্পর্শ করে তাই হয় অপূর্ব। এও তো ছাড়বার জো নেই। সুরের গান, না-সুরের গান, কাকে ছেড়ে কাকে বাছব? আমি দুইকেই সমান স্বীকার করে নিয়েছি। এক জাগয়ায় কেবল আমার বাধে। খেলনা নিয়ে নিজেকে ভোলাতে আমি কিছুতেই পারি নে। এটা পারে নিতান্তই শিশু বধূ। সাথী আছেন কাছে বসে তার দিকে পিছন ফিরে খেলনার বাক্স খুলে বা একেবারেই সময় নষ্ট করা। এতে করে সত্য অনুভ‚তির রস যায় ফিকে হয়ে। ফুল দিতে চাও দাও না, এমন কাউকে দাও যে-মানুষ ফুল হাতে নিয়ে বলবে বাঃ। তার সেই সত্য খুসি আনন্দে গিয়ে পৌঁছায়। শিলাইদহের বোষ্টমী আমার হাতে আম দিয়ে বললে, তাকে দিলুম। এই তো সত্যকার দেয়া- আমারই ভোগের মধ্যে তিনি আমটিকে পান। পূজারী ব্রাহ্মণ সকাল বেলায় গোলকচাঁপার গাছে বাড়ি মেরে ফুল সংগ্রহ করে ঠাকুরঘরে যেত- তার নামে পুলিশে নালিষ করতে ইচ্ছা করত- ঠাকুরকে ফাঁকি দিচ্ছে বলে। সেই ফুল আমার মধ্যে দিয়ে ঠাকুর গ্রহণ করবেন বলেই গাছে ফুল ফুটিয়েছেন আর আমার মধ্যে ফুলে আনন্দ আছে। ঠাকুরঘরে যে মূর্ত্তি প্রতিদিন এই চোরাই মাল গ্রহণ করে সে তো সমস্ত বিশ্বকে ফাঁকি দিলে- মূঢ়তার ঝুলির মধ্যে ঢেকে তার চুরি। কত মানুষকেই বঞ্চিত করে তবে আমরা এই দেবতার খেলা খেলি। ঠাকুরঘরের নৈবেদ্যের মধ্যে আমরা ঠাকুরের সত্যকার প্রাপ্যকে প্রত্যহ নষ্ট করি।

এমন অসংখ্য পত্রৌদ্ধৃত্তি রয়েছে উল্লেখ করার মতো। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পত্রের কাছে আশ্রয় নিয়ে যেমন সমৃদ্ধ করেছে পত্রসাহিত্য। একইভাবে নিজেও সাবলীল মেলে ধরতে পেরেছেন নিজেকে পত্রেরই মাধ্যমে। অনেক পত্রসাহিত্যই পত্র-মাধ্যম ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে এ প্রসাদগুণ নিয়ে সৃষ্ট হতে পারতেন না। এ প্রসঙ্গেও কথা বলতে ছাড়েন নি বিশ^কবি। তিনি লিখেছেন, ‘পত্রধারায় ছিন্নপত্র পর্যায়ে যে-চিঠির টুকরোগুলি ছড়ানো হয়েছে তার অধিকাংশই আমার ভাইঝি ইন্দিরাকে লেখা চিঠির থেকে নেয়া। তখন আমি ঘুরে বেড়াচ্ছিলুম বাংলার পল্লীতে পল্লীতে, আমার পথ-চলা মনে সেই-সকল গ্রামদৃশ্যের নানা নতুন পরিচয় ক্ষণে ক্ষণে চমক লাগাচ্ছিল; তখনি তখনি তাই প্রতিফলিত হচ্ছিল চিঠিতে। কথা কওয়ার অভ্যাস যাদের মজ্জাগত, কোথাও কৌতুক-কৌত‚হলের একটু ধাক্কা পেলেই তাদের মুখ খুলে যায়। যে বকুনি জেগে উঠতে চায় তাকে টেকসই পণ্যের প্যাকেটে সাহিত্যের বড়ো হাটে চালান করবার উদ্যোগ করলে তার স্বাদের বদল হয়। চার দিকের বিশ্বের সঙ্গে নানা-কিছু নিয়ে হাওয়ায় হাওয়ায় আমাদের মোকাবিলা চলছেই, লাউড-স্পীকারে চড়িয়ে তাকে ব্রডকাস্ট করা সয় না। ভিড়ের আড়ালে চেনা লোকের মোকাবিলাতেই তার সহজরূপ রক্ষা হতে পারে।

আলোকিত রাঙামাটি

জনপ্রিয়