চার্লি চ্যাপলিন
নামজাদা লেখক স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের সৃষ্টি শার্লক হোমস চরিত্রটি তখন বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছে। ‘দ্য সাইন অব ফোর’ বইটিপ্রকাশিত হওয়ার কিছুদিন পর একদিন ডয়েল মঞ্চনাটক দেখতে গেলেন। সেখানে এক কিশোরের অভিনয় তার মনে ধরে। নাটক শেষে কাছে ডেকে বাহবা দিলেন, “তুমি চালিয়ে যাও। তোমার মাঝে প্রতিভা আছে।” বালকের উত্তর শুনে কিছুটা বিরক্ত হলেন ডয়েল। কী বলেছিল সে বালক? শুনলে আপনিও চমকে যাবেন! “আপনি আর আমি কি একসঙ্গে কাজ করতে পারি? দু’জনের আয় সমানভাবে ভাগ করে নেয়া যাবে না হয়!” দেখুন বালকের ধৃষ্টতা! অবশ্য ডয়েল তখনো জানতেন না যে একদিন এই বালকই শতচ্ছিন্ন কোট আর হাতে একটি ছড়ি নিয়ে শাসন করবে রূপালি পর্দা। তার হাস্যরসে মজে থাকবে সারা পৃথিবী। ছোটখাট গড়নের এই মানুষটি হবে সকলের প্রিয় চার্লি চ্যাপলিন। আজ এই চার্লি চ্যাপলিনকে নিয়েই আয়োজন-
চার্লস স্পেন্সার চ্যাপলিন ১৮৮৯ সালের ১৬ এপ্রিল দক্ষিণ লন্ডনের ওয়ালওর্থের ইস্ট স্ট্রীটে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তিনি সত্যিই এখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কিনা, তা নিয়ে কিছুটা সন্দেহ রয়েছে বৈ-কি! ১৮৯১ সালের এক গণনা অনুযায়ী জানা যায়, ইস্ট স্ট্রীটের এই অঞ্চলে তার মা হান্না চ্যাপলিন এবং ভাই সিডনি জন হিল এখানেই থাকতেন। চ্যাপলিনের বাবার নাম চার্লস চ্যাপলিন সিনিয়র। পিতামাতা দু’জনেই ছিলেন সঙ্গীতপ্রেমিক। মা বেশ ভালো পিয়ানো বাজাতেন অভিনয়ও করতেন। তবে দুঃখের কথা, জীবনের বেশিরভাগ সময়েই এই নারী কাটিয়েছেন মানসিক রোগীদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে। চ্যাপলিনের বাবা গায়ক হিসেবে বেশ সুনাম কামানোর পর মদের নেশায় চুর হয়ে নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে ফেলেন। মাত্র ৩৭ বছর বয়সেই মৃত্যুবরণ করেন চার্লস চ্যাপলিন সিনিয়র। শুরু হয় চ্যাপলিনের দুঃখ কষ্টের সূচনা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ না নেয়ায় ব্রিটিশ গণমাধ্যম চ্যাপলিনের সমালোচনা করতে শুরু করেন। ব্রিটিশ বা মার্কিন, কোনো সরকারই তাকে আমন্ত্রণ জানায়নি যদিও তিনি মার্কিন খসড়াতে রেজিস্টার করেছিলেন। থার্ড লিবার্টি বন্ড ক্যাম্পেইনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির জন্য তিনি একমাস ভ্রমণ করে টাকা জমিয়েছিলেন সাহায্যের জন্য। এছাড়াও একটি প্রোপাগান্ডা চলচ্চিত্র প্রযোজনা করে সেটি সরকারকে দান করেন। ছবিটির নাম ‘শোল্ডার আর্মস’। ১৯১৭ সালের জুন মাসে ফার্স্ট ন্যাশনাল এক্সিবিটর’স সার্কিটের সঙ্গে এক মিলিয়ন ডলারে আটটি ছবি তৈরির জন্য চুক্তিবদ্ধ হন চার্লি। নতুন লগ্নিকারী খুঁজতে শুরু করলেন তিনি। সানসেট বুলভার্দে পাঁচ একর জমির ওপর তৈরি হলো স্টুডিও। সকল ধরনের স্বাধীনতা দেয়া হলো চার্লিকে।
শৈশব কৈশোরের বেশিরভাগ সময়েই এতিমখানায় কেটেছে চার্লির। সেখানে ঠিকমতো খাবার জুটতো না কপালে। পড়াশুনা ঠিকভাবে শেষ করতে পারেননি চার্লি। বাবার সাহায্যে এইট ল্যাঙ্কাশায়ার ল্যাডস ক্লগ ডান্সিং গ্রুপের একজন সদস্য বনে যান তিনি। পুরো যুক্তরাজ্য জুড়ে এই গ্রুপ গান-বাজনা ও মঞ্চনাটক নিয়ে ভ্রমণ করত। কেইন হিল মেন্টাল এসাইলামে ছিলেন মা হান্না। ছাড়া পাবার পর চার্লি লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ডের থিয়েট্রিকাল এজেন্সিতে নিজের নাম রেজিস্টার করেন। ১৯০৩ সালে এইচ এ সেইন্টবারির ‘জিম আ রোমান্স অব কক্যাইন’ নাটকে প্রথম অভিনয়ে হাতেখড়ি হয় চ্যাপলিনের। খবরের কাগজ বিক্রেতার চরিত্র পেয়েছিলেন তিনি। দুই সপ্তাহ পরেই অবশ্য নাটকটির মঞ্চায়ন বন্ধ হয়ে যায়। চার্লস ফ্রোম্যানের প্রযোজনায় ‘শার্লক হোমস’ নাটকে বিলি দ্য পেইজবয়ের চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ মিললৈা চার্লির। এরপর উইলিয়াম জিলেটের মতো নামজাদা অভিনেতার সঙ্গে অভিনয় করার সুযোগও জুটেছে তার। ১৯০৬ সালের মে মাসে ‘দ্য জুভেনাইল এক্ট ক্যাসি’স সার্কাসে যোগদান করেন তিনি। এখানে তিনি বার্লেস্ক কাজের জন্য খুবই সমাদৃত হন। বার্লেস্ক হচ্ছে হাস্যরসের মাধ্যমে জীবনের কঠোর বাস্তবতা ফুটিয়ে তোলার দৃশ্য অভিনয়ের মাধ্যমে দৃশ্যায়ন করা। ১৯০৭ সালে চার্লি চ্যাপলিন একজন কমেডি অভিনেতা হিসেবে খ্যাতি পেতে শুরু করেন, যদিও তার একক অভিনয় খুব বেশি দর্শকপ্রিয়তা পায়নি।
ফ্রেড কার্নোর কমেডি প্রতিষ্ঠানের তখন বেশ নামডাক। চার্লিকে নিজেদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ করবেন কিনা, তা নিয়ে বেশ ইতস্তত করতে লাগলেন তারা। অবশেষে দোনোমনা করতে করতে চার্লিকে দুই সপ্তাহের ট্রায়ালের পর নিয়ে নিলেন। এখানে ছোটখাট রোল করতে থাকলেন চার্লি। ১৯১০ সালে ‘জিমি দ্য ফিয়ারলেস’ এর প্রত্যাশিত সাফল্য তার নাম ও যশ বাড়িয়ে দেয়। প্রেস চার্লিকে নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ১৯১০ সালের অক্টোবর মাসে ভডেভিল (কমেডির ধরন) এর উদ্দেশ্যে উত্তর আমেরিকা ভ্রমণ করেন চার্লি। সেখানে তার অভিনয় পেন্টোমাইম (মূকাভিনয়) জগতের অন্যতম একজন আর্টিস্ট হিসেবে খ্যাতি এনে দেয়। ‘দ্য ইনেব্রিয়েট স্যুয়েলে’ একজন মদ্যপের চরিত্র রুপায়ন তাকে এই খ্যাতি এনে দেয়। ১৯১৪ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি চার্লি অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র ‘মেকিং আ লিভিং’ মুক্তি পায়। যদিও ছবিটি তিনি খুব একটা পছন্দ করেননি, তারপরও এই ছবিতে তার অভিনয় একজন প্রথম সারির কৌতুকাভিনেতা হিসেবে মানুষের কাছে পরিচিত করে। একই সালের ৯ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পায় ম্যাবেল’স স্ট্রেঞ্জ প্রেডিকামেন্ট নামের চলচ্চিত্র। এটি ছিল চার্লি অভিনীত দ্বিতীয় ছবি। এখানেই তার বিখ্যাত ‘ভবঘুরের পোষাক’ দর্শকের সামনে নিয়ে আসেন। ঢোলা প্যান্ট, আঁটসাঁট কোট, ছোট একটি হ্যাট, পায়ের চেয়ে বড় সাইজের জুতা এবং একটি ছোট গোঁফ দিয়েই চার্লি চ্যাপলিনের আইকনিক যাত্রার শুরু। তবে ‘কিড অটো রেস এট ভেনিস’ ছবিতে প্রথম এই পোষাক পরেন তিনি। এটি তৈরি করা হয়েছিল ম্যাবেলের আগে কিন্তু মুক্তি দেয়া হয় দু’দিন পর।
কিস্টোন স্টুডিওর মালিক ম্যাক সেনেট চার্লিকে পরবর্তী ছবিটি পরিচালনা করার অনুমতি দিলেন। তবে একটি শর্তও জুড়ে দিলেন। যদি ছবিটি সমাদৃত না হয়, চার্লিকে পনেরোশো ডলার জরিমানা গুণতে হবে। রাজি হলেন চার্লি। ১৯১৪ সালের ৪ঠা মে ‘কট ইন দ্য রেইন’ ছবিটি মুক্তি পাবার পর বিপুল দর্শক সমাদৃত হয়। চার্লি পরিচালক হিসেবেও নিজের জাতটা চেনালেন! এরপর কিস্টোন স্টুডিও থেকে নিজের প্রায় সবকটি ছবিই পরিচালনা করেছেন চার্লি। ১৯১৪ সালের নভেম্বর মাসে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘টিলি’স পাংচারড রোমান্স’-এ সহায়ক রোলে ছিলেন চার্লি। সেনেটের পরিচালনায় এই ছবিটি বাণিজ্যিক সাফল্য লাভ করে, চার্লিরও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় অনেকাংশে। ‘দ্য ব্যাঙ্ক’ ছবির শেষ দৃশ্যে একটি বেদনাবিধুর পরিস্থিতির সঙ্গে দর্শককে পরিচয় করিয়ে দেন চার্লি। ১৯১৫ সালে মুক্তি পাওয়া এই চলচ্চিত্রটি ছিল কমেডি, তবে তা সত্ত্বেও শেষ দৃশ্যের জন্য ভূয়সী প্রশংসা করা হয় তাকে। এরপর থেকেই আন্তর্জাতিক তারকা হিসেবে খ্যাতি পেতে থাকেন। তাকে নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়, গান তৈরি হয় কমিক স্ট্রিপ এবং কার্টুন।
১৯১৮ সালের এপ্রিল মাসে মুক্তি পায় ‘আ ডগ’স লাইফ’। নতুন চুক্তির অধীনে এটিই ছিল তার প্রথম ছবি। ফরাসি চিত্র পরিচালক লুই দেলা তার এই ছবিটিকে চলচ্চিত্র জগতের প্রথম সম্পূর্ণ শিল্পের কাজ হিসেবে অভিহিত করেন। সেই বছরই মিল্ডারড হ্যারিসকে বিয়ে করেন চার্লি। বিয়ের আগেই হ্যারিস গর্ভধারণ করায় গণমাধ্যমের সমালোচনা এড়াতেই অনেকটা বাধ্য হয়েই দ্রুত লুকিয়ে বিয়ের কাজটি সেরে ফেলেন চার্লি। ১৯২০ সালে তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।
আলোকিত রাঙামাটি