রাঙামাটি । বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ , ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকাশিত: ১১:৩৮, ২৪ এপ্রিল ২০২৩

বৃহত্তম নৃগোষ্ঠী বাঙালীরাই বাংলাদেশের আদিবাসীঃ জাতিসংঘে বাংলাদেশ

বৃহত্তম নৃগোষ্ঠী বাঙালীরাই বাংলাদেশের আদিবাসীঃ জাতিসংঘে বাংলাদেশ
ফাইল ছবি

জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের ২২তম অধিবেশনে বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করেছে, বাংলাদেশে প্রায় ৯৯ ভাগ জনগণ হল বাঙালি। বাঙালিরাই বৃহত্তম এথনিক গ্রুপ এবং এ ভূমির আদিবাসী জনগোষ্ঠী। অন্যদিকে একই সম্মেলনে অংশ নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধি দল পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন ও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মোসাম্মৎ হামিদা বেগম


পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মোসাম্মৎ হামিদা বেগম বলেছেন, বাংলাদেশে প্রায় ৯৯ ভাগ জনগণ হল বাঙালি। যারা বৃহত্তম এথনিক গ্রুপ এবং ইন্ডিজেনাস টু দ্যা ল্যান্ড। যাহোক, আমাদের আরও মাইনোরিটি গ্রুপ আছে যারা আমাদের সংবিধানে নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার ও সুযোগ নিয়ে যথাযথভাবে স্বীকৃত হয়েছে। তাদের সংখ্যা ৫০টি যার মধ্যে ১৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে ও ৩৭টি সমতল অঞ্চলে বসবাস করে। সরকার অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তাদের আমাদের মূলধারার উন্নয়ন কাতারে নিয়ে আসার জন্য। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের ২২তম অধিবেশনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি এক কথা বলেন। গত ১৭ এপ্রিল এই অধিবেশন শুরু হয়েছে।

এ সময় মোসাম্মৎ হামিদা বেগম আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ সময় ধরে সশস্ত্র সংঘাত ছিল যা সরকার ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধির মধ্যে ১৯৯৭ সালে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে দূর হয়। গতবছরের দেয়া আমাদের অঙ্গীকার অনুযায়ী, আমাদের আন্তঃমন্ত্রণালয়ে পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন পর্যায় পর্যালোচনা করেছি। আমরা আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৬৫টি ধারা সম্পূর্ণভাবে, ৩টি ধারা আংশিকভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে এবং বাকি ৪টি ধারা বাস্তবায়নাধীন অবস্থায় রয়েছে। গত ১৯ তারিখ অধিবেশনের তৃতীয় দিন এজেন্ডা আইটেম ৫ (ডি) আদিবাসী বিষয়ক স্প্যাশাল রেপোর্টেয়ার ও জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক এক্সপার্ট ম্যাকানিজম এর সাথে মানবাধিকার সংলাপ সেশনে তিনি সরকারের পক্ষ থেকে এ বিবৃতি দেন।

এর আগের দিন অর্থাৎ গত ১৮ এপ্রিল অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে অধিবেশনের বিশেষ প্রতিপাদ্য এজেন্ডা আইটেম ৩ নিয়ে আলোচনা হয়। তখন বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান মি. নিখিল কুমার চাকমা এক বিবৃতিতে প্রায় একই তথ্য তোলে ধরেন। লাস্ট এথনিক কমিউনিটি গ্রুপের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় দিয়ে নিখিল কুমার চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৬৫টি ধারা সম্পূর্ণভাবে, ৩টি ধারা আংশিকভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে এবং বাকি ধারাগুলো বাস্তবায়নাধীন অবস্থায় রয়েছে। আমরা আমাদের লোকজনের আর্থ-সামাজিক অবস্থা উন্নতির জন্য বিভিন্ন উন্নয়ন সংগঠনের সাথে কাজ করছি। চলতি বছরে ৬০টি প্রকল্প বাষির্ক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় রয়েছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে মোট ১৫৫৫টি উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ‌’আদিবাসীদের আন্দোলনকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সাব্যস্ত সরকারী প্রচেষ্টার’ বিরুদ্ধে জাতিসংঘের স্পেশাল রেপোর্টিয়ারের হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। গত ১৭ এপ্রিল শুরু হওয়া নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের ২২তম অধিবেশনে তৃতীয় দিনে অর্থাৎ ১৯ তারিখ অধিবেশনের তৃতীয় দিন এজেন্ডা আইটেম ৫ (ডি) আদিবাসী বিষয়ক স্প্যাশাল রেপোর্টেয়ার ও জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক এক্সপার্ট ম্যাকানিজম এর সাথে মানবাধিকার সংলাপ সেশনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধি হিসেবে দেয়া বিবৃতিতে তিনি এ দাবী করেন।


চঞ্চনা চাকমা তার বিবৃতিতে, ২ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির রজতজয়ন্তী উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভঙ্গুর মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরার জন্য এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানোর জন্য জাতিসংঘের স্পেশাল রেপোর্টিয়ারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, “বর্তমানে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরিবর্তে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সামরিক সমাধানের পথ বেছে নিয়েছে। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন এবং সেনাবাহিনী তথা সরকারের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের জন্য আদিবাসী জুম্ম জনগণের চলমান আন্দোলনের অপরাধীকরণ তীব্রতর হয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে, তিনি আদিবাসী জুম্ম জনগণের উপর অপরাধীকরণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের সাথে বারবার যোগাযোগ বা হস্তক্ষেপের জন্য বিশেষ র‌্যাপোর্টারের প্রতি আহ্বান জানান”।

এই সম্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল অংশ নিচ্ছে। এ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জেএসএস নেতা প্রীতি বিন্দু চাকমা। তিনি তার বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে (সিএইচটি) বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত শুরু করার জন্য জাতিসংঘে আদিবাসীদের অধিকার বিষয়ক স্পেশাল রেপোর্টিয়ারের প্রতি আহ্বান জানান। এসময় তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির জন্য সহযোগিতা না করা পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নেওয়া বন্ধ করার দাবী জানান।


জেএসএস দলনেতা তার ভাষণে বলেন, “২০০৭ সালে তাদের অস্তিত্বের জন্য বিশ্বজুড়ে আদিবাসীদের অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্র গ্রহণ করার জন্য জাতিসংঘের কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ এবং জাতিসংঘের এই পদক্ষেপের কারণে, অনেক আদিবাসী সম্প্রদায় বিশ্বের বিভিন্ন অংশে ভালভাবে বেঁচে আছে।

বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জনগণকে সীমিত অধিকার প্রদানের জন্য ১৯৯৭ সালে পিসিজেএসএস এর সাথে একটি চুক্তি করে। প্রকৃতপক্ষে, সরকার চুক্তিটি নিয়ে একটি কৌশলী ভূমিকা পালন করেছিল কারণ ২৫ বছরেও এটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা আগের মতো সামরিকভাবে সমাধান করতে চায়।”

তিনি বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পরিপূর্ণ এবং তারা প্রশাসন থেকে শুরু করে রাস্তা নির্মাণ থেকে শুরু করে ব্যবসা পরিচালনা ও প্রতিটি জুম্ম আদিবাসীকে তল্লাশী করে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে চুক্তি বা শান্তি বাস্তবায়নে সামরিক বাহিনী প্রধান বাধা।”

তিনি আরো বলেন, “আপনি হয়তো অবগত আছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমতি ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদেশিদের প্রবেশ নিষেধ। এমনকি যদি কাউকে অনুমতি দেওয়া হয়, তবে তাকে সামরিক বাহিনীর একজন এজেন্টের উপস্থিতিতে আদিবাসীদের সাথে কথা বলতে হবে। গত বছরের আগস্টে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট বাংলাদেশ সফর করেন, কিন্তু তাকে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি যা একটি প্রমাণিত সত্য যে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল মানবাধিকারের ক্ষেত্রে ভালো অবস্থায় নেই।”

জেএসএস দলনেতা এসময় জাতিসংঘ আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের মাধ্যমে জাতিসংঘের কাছে তিন দফা আবেদন জানান। এগুলো হলো:

“১) বিশেষ প্রতিবেদককে অবশ্যই পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত শুরু করতে হবে।

২) ২০১১ সালে স্থায়ী ফোরামের সুপারিশ অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির জন্য সহযোগিতা না করা পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নেওয়া বন্ধ করুন।

৩) বিশেষজ্ঞ ব্যবস্থা এমন হওয়া উচিত যাতে বিশ্বের যেখানেই আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে কোনো দেশের সামরিক বাহিনী মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত থাকুক না কেন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের যোগ্য হতে দেওয়া যাবে না এবং এই জাতীয় আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করতে হবে।”

আগামী ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত এ সম্মেলন চলবে। সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ছাড়াও এনজিও কমকর্তা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রতিনিধি দল অংশগ্রহণ করেছেন।

জনপ্রিয়