রাঙামাটি । শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ , ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাঙামাটি (সদর) প্রতিনিধিঃ-

প্রকাশিত: ২০:০২, ২ জুন ২০২৩

আপডেট: ২০:১৩, ২ জুন ২০২৩

শুকিয়ে গেছে কাপ্তাই হ্রদ, যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত

শুকিয়ে গেছে কাপ্তাই হ্রদ, যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত

অস্বাভাবিকভাবে শুকিয়ে গেছে কাপ্তাই হ্রদ। হ্রদের পানি শুকিয়ে নানা স্থানে ভেসে উঠেছে চর। ফলে একদিকে যেমন হ্রদের পানির উপর নির্ভরশীল নৌ-যোগাযোগ ব্যহত হচ্ছে, ক্ষতি হচ্ছে নৌ-কেন্দ্রীক ব্যবসা-বাণিজ্যের, অন্যদিকে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন নেমেছে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। পাশাপাশি প্রভাব পড়েছে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসা-বাণিজ্যের উপরও।

রাঙামাটির দশটি উপজেলার মধ্যে প্রায় ৭টি উপজেলারই যোগাযোগের মাধ্যম নৌ-পথ। কিছু উপজেলায় নৌ-পথের পাশাপাশি সড়ক যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকলেও জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি ও বরকল উপজেলায় যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌ-পথ। হ্রদের পানি অতিরিক্ত পরিমাণ কমে যাওয়াতে এসব উপজেলায় এখন জেলা সদর থেকে কোনো লঞ্চ যাতায়াত করছে না। ছোট ডিঙি নৌকা অথবা স্পিডবোটের মাধ্যমে এসব উপজেলায় যাতায়াত করছে উপজেলার বাসিন্দারা। এতে করে যেমন বেড়েছে যাতায়াত খরচ, তেমনি বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়।

বরকল উপজেলার বাসিন্দা সুশোভন দেওয়ান বলেন, ‘আগে পানি কমলেও এত বেশি কমে যেত না। কিন্তু এই বছর অতিরিক্ত পানি কমে গিয়েছে। বরকল থেকে রাঙ্গামাটি আসা-যাওয়া করতে আমাদের আগে যে ভাড়া লাগতো, এখন তার তিনগুণ বেশি ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। এতে আমাদের কষ্টও বেড়েছে, আর্থিক ক্ষতিও হচ্ছে।’

বোটচালক ইউনুস মিয়া বলেন, ‘এখন সুবলং ইউনিয়ন পর্যন্তও বোট নিয়ে যাওয়া যাচ্ছেনা। কারণ সবজায়গায় চর পড়েছে এবং চরে বোট আটকে যাচ্ছে। আগে বরকল পর্যন্ত যেতে আমাদের খরচ হতো ১২ লিটার তেল এখন সেখানে ২০লিটার তেল দিয়েও পৌঁছানো যায় না। খরচ বাড়লেও ভাড়া বাড়েনি।’

রাঙামাটি বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে কাপ্তাই হ্রদ। টুরিস্ট বোটে করে হ্রদে ভ্রমণ করতেই বেশি পছন্দ করেন পর্যটকরা। কিন্তু হ্রদে পানি না থাকায় পর্যটক কেন্দ্রীক ব্যবসা বাণিজ্যেও ভাটা পড়েছে। কমেছে পর্যটকদের সংখ্যা।

রাঙামাটি পর্যটন ঘাটের ইজারাদার এবং ট্যুরিস্ট বোট মালিক সমিতির সহসভাপতি রমজান আলী বলেন, ‘আমাদের খুব খারাপ সময় যাচ্ছে। রাঙামাটিতে এখন পর্যটক নেই বললেই চলে। প্রায় বোট চালকই এখন কর্মহীন অবস্থায় আছে। পেটের দায়ে অনেকে বোট চালানোর পরিবর্তে অন্যান্য কাজ শুরু করেছেন।’

নৌযান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল (যাত্রী পরিবহন) রাঙামাটি জোনের সভাপতি মঈনউদ্দীন সেলিম বলেন, ‘হ্রদের পানি  শুকিয়ে যাওয়ায় প্রায় চার মাসেরও বেশি সময় ধরে ৬ উপজেলার সঙ্গে আমাদের লঞ্চ যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। আগে যেখানে দৈনিক চার থেকে পাঁচ হাজার মানুষ বিভিন্ন উপজেলায় যাতায়াত করতেন এখন সেটা ২০০ থেকে ৩০০-তে নেমে এসেছে।’

তিনি জানান, ‘কাপ্তাই হ্রদে এই মুহূর্তে ড্রেজিং করা খুব বেশি জরুরি হয়ে দাড়িয়েছে। বিভিন্ন সময়ে আমরা নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়, বিআইডব্লিউটিএ, রাঙামাটি জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন জায়গায় কাপ্তাই হ্রদ ড্রেজিংয়ের আবেদন করেছি। কিন্তু দীর্ঘ একটা সময় পার হয়ে গেলেও কখনো কাপ্তাই হ্রদে ড্রেজিং হয়নি। এই কারণেই বিভিন্ন স্থানে চরের সৃষ্টি হয়েছে। আর এই ড্রেজিং না হওয়ার কারণেই শুষ্ক মৌসুমে হ্রদে পানির প্রবাহটা ঠিক থাকছে না। হ্রদে অতি দ্রুত ড্রেজিং করার দাবি জানান তিনি।’

এদিকে, হ্রদের পানির ওপর নির্ভরশীল কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক এটিএম আব্দুজ্জাহের বলেন, ‘রুলকার্ভ অনুযায়ী কাপ্তাই হ্রদে এখন পানি থাকার কথা ৭৬ এমএসএল (মীনস সি লেভেল), কিন্তু পানি আছে ৭২ দশমিক ৬৭ এমএসএল। যা স্বাভাবিকের তুলনায় কম। মৌসুম হিসেবে বৃষ্টি শুরু হয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও বৃষ্টি হচ্ছে না, ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। বর্তমানে একটি ইউনিট সচল আছে, যা থেকে ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে।’

রাঙামাটির পরিবেশবাদী সংগঠন গ্লোবাল ভিলেজের পরিচালক হেফাজত বারী সবুজ বলেন, ‘১৯৬২ সালে কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টির পর থেকে একবারও ড্রেজিং করা হয়নি। যেহেতু এটি একটি কৃত্রিম হ্রদ তাই এটির রক্ষাণাবেক্ষণ এবং ড্রেজিং করা অত্যন্ত জরুরি। ড্রেজিং না করার ফল আমরা ইতোমধ্যেই পাচ্ছি। যেমন-হ্রদে এই সময়ে যে পরিমাণ পানি থাকার কথা তা নেই। অতি দ্রুত যদি কাপ্তাই হ্রদ ড্রেজিং করা না হয় তবে অদূর ভবিষ্যতে দেখা যাবে পার্বত্যঞ্চলেও বন্যার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।’

জনপ্রিয়