রাঙামাটি । মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪ , ৪ চৈত্র ১৪৩০

নিউজ ডেস্কঃ-

প্রকাশিত: ১২:০৪, ২ জুলাই ২০২২

দেশের পালে পরিবর্তনের হাওয়া

দেশের পালে পরিবর্তনের হাওয়া

স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হয়েছে মাত্র এক সপ্তাহ। অথচ এরইমধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় বইতে শুরু করেছে আর্থ-সামাজিক অবস্থার আমূল পরিবর্তনের হওয়া। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে পুরো দেশেই।

পদ্মা সেতু চালুর সঙ্গে সঙ্গেই রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহণসহ সব ধরনের সুযোগ হাতের মুঠোয় চলে আসায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় নতুন করে গড়ে উঠতে শুরু করেছে বিপুল সংখ্যক মৎস্য-পশু খামার, নানা ধরনের বাণিজ্য ও শিল্প-কলকারখানা। ফলে ঝড়ের গতিতে পরিবর্তন হতে শুরু করেছে সেখানকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা। চাঙা হয়ে উঠছে দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতি। নতুন নতুন শিল্প-কলকারখানা ও খামারসহ বহু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে শুরু করায় সেখানকার মানুষের কর্মসংস্থানও বেড়ে চলেছে। সেতুর দুই পাড় ইতোমধ্যেই পর্যটন কেন্দ্রে রূপ নেওয়ায় সেখানকার বাসিন্দাদের বেকারত্বের হারও দ্রম্নত কমার আভাষ পাওয়া গেছে।

প্রশাসনিক সূত্রগুলো জানায়, স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে মৎস্য চাষ, উৎপাদন ও আহরণ করে চাহিদা অনুযায়ী ঢাকাসহ দেশের যে কোনো এলাকায় সরবরাহ করা সহজ হয়েছে। তাই মৎস্যজীবীরা এরইমধ্যে নতুন নতুন মৎস্য খামার ও হ্যাচারি তৈরিসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে। বরগুনা-পাথরঘাটাসহ যেসব এলাকার মানুষ সাগর-নদী থেকে মাছ আহরণসহ স্থানীয়ভাবে মাছ চাষাবাদ ও উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত, তারাও নতুন নতুন পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছেন।

তারা আশাবাদী, এখন আর ফেরিঘাটে যানজটে পড়ে মাছ নষ্ট হওয়ার কোনো দুশ্চিন্তা থাকবে না। মৎস্য ব্যবসায় আমূল পরিবর্তন আসবে। যার সুফল পাবেন পাইকার থেকে শুরু করে প্রান্তিক জেলেরা। অনেকেই এরইমধ্যে এ ব্যবসায় নতুন করে পুঁজি বিনিয়োগে সাহসী হয়ে উঠেছেন। সাগর ও নদী থেকে মাছ আহরণের জন্য কেউবা দীর্ঘ জাল, কেউবা ট্রলার কেনায় বড় অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। যার ফলশ্রম্নতিতে সেখানে কর্মচাঞ্চল্য বাড়তে শুরু করেছে।

উপকূলীয় বরগুনা জেলার মৎস্য ব্যবসায়ী লুৎফুল কবীর জানান, সামুদ্রিক মাছের পাশাপাশি উলেস্নখযোগ্য হারে স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন জাতের মাছের চাষাবাদ হলে ফেরিঘাটে সময়ক্ষেপণের কারণে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা পদ্মার ওপাড়ে মাছ চালানে উৎসাহী হতেন না। তারা মাছের দাম কম পেতেন। তবে পদ্মা সেতু চালুর পর এ সংকট অনেকটাই কেটে গেছে। তাই মৎস্যজীবী অনেকেই নতুন নতুন জলাশয় লিজ নিয়ে মাছ চাষের পরিকল্পনা করছেন। কেউ বা নিজ জমিতে কাটছেন বিশাল পুকুর। এছাড়া মৎস্য পরিবহণের জন্য ফ্রিজিং ভ্যানে বড় অঙ্কের বিনিয়োগেও হিড়িক পড়েছে।

পাথরঘাটা মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের আড়তদার কামাল হোসেন বলেন, 'স্থানীয়ভাবে যে টাকায় মাছ কিনি, ঢাকায় মাছ পাঠাতে প্যাকিং, বরফ ও পরিবহণে তার চেয়ে বেশি টাকা খরচ হতো। মাওয়া ঘাটে ফেরির সিরিয়ালের জন্য ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা দিতে হতো। এতে খুব বেশি লাভ থাকত না। তবে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর খরচের পাশাপাশি ভোগান্তি কমেছে। তাই পাথরঘাটাতেই নতুন করে বেশ কয়েকটি মাছের আড়ত গড়ে উঠেছে। নতুন আড়তে শুধু কর্মসংস্থান বাড়েনি, নানা ধরনের কর্মতৎপরতা বেড়েছে। নতুন আড়তদাররা মৎস্য খামারিদের দাদন দেওয়ায় তারা বেশি মাছ উৎপাদনে ঝুঁকেছে।

বাংলাদেশ মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী জানান, এখন পাথরঘাটা মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনে মাছ কিনতে আসা পাইকারদের বেশিরভাগ উত্তরাঞ্চলের। মাওয়া ফেরির কারণে ঢাকার পাইকার ও বড় বড় ব্যবসায়ী চট্টগ্রাম থেকে মাছ কেনেন। কিন্তু পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগেই ঢাকার বড় বড় মৎস্য ব্যবসায়ী এখানকার মাছ কেনার জন্য চুক্তি করতে শুরু করেছেন।

বরগুনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপত্বি মো. জাহাঙ্গীর কবির জানান, প্রক্রিয়াজাতকরণের তেমন কোনো ব্যবস্থা না থাকায় সেখানকার মৎস্য ও কৃষিসামগ্রী ঢাকায় পৌঁছানো যেত না। কিন্তু পদ্মা সেতুর কারণে এ অঞ্চলে এরইমধ্যে প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে উঠতে শুরু করেছে। অনেকেই এ খাতে মোটা অঙ্ক বিনিয়োগ করছেন।

এদিকে শরীয়তপুরের কনেশ্বর ইউনিয়নের মাছের খামারি মোবারক হোসেন জানান, পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ায় স্বল্প সময়ে কম পরিবহণ খরচেই শরীয়তপুর থেকে নিয়মিত মাছ ঢাকার বাজারে পাঠানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। স্থানীয় বাজারের চেয়ে সেখানে কেজিপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকা বেশি দাম পাওয়া যাবে। তাই দ্রম্নত ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় প্রায় দশ বিঘার একটি পুকুর এবং আরও দুইটি পরিত্যক্ত হ্যাচারি লিজ নিয়েছেন। তার দুই প্রতিবেশীও এ খাতে বড় পুঁজি বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছেন। এছাড়া শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা, সেনেরচর, জয়নগর, বড়গোপালপুর এবং নাড়িয়া উপজেলার ভোজেশ্বর, মোকাক্তারচরে অন্তত ৩০টি নতুন মৎস্য খামার গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে এরইমধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে গরু-ছাগলসহ বিভিন্ন গবাদিপশু পালন ও দুগ্ধ উৎপাদনকারী খামারেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সহজ সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে এ খাতের দীর্ঘদিনের সংকট দূর করে কয়েক হাজার কোটি টাকা আয়ের আশা করছেন প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা।

তারা বলছেন, যোগাযোগ সংকটের কারণে থমকে ছিল সম্ভাবনাময় এ খাত। আগে কোরবানির পশু ও দুগ্ধতাজ পণ্য ঢাকায় পৌঁছাতে যেখানে ৭-৮ ঘণ্টা থেকে ১৪-১৫ ঘণ্টা সময় লাগত, সেখানে এখন লাগছে সর্বোচ্চ ৫-৬ ঘণ্টা। ফলে সময় ও খরচ সাশ্রয়ের মাধ্যমে খামারিরা লাভবান হবেন অনেক বেশি। এর ফলে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোক্তা।

খামারিরা জানান, কোরবানির ঈদের দুই-তিন সপ্তাহ আগে ব্যাপারীরা তাদের কাছ থেকে বেশখানিকটা কম দামে গরু কিনে নিয়ে যেতেন। ফেরিঘাটে দীর্ঘ বিলম্ব ও নৌপথে নানা ঝুঁকির কারণে ঢাকায় গরু নিয়ে যাওয়ার সাহস পেতেন না তারা। তবে এবার বেশিরভাগ খামারি নিজেরাই গরু নিয়ে ঢাকায় যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

শরীয়তপুরের গরু খামারি ইমদাদ আলী বলেন, গাড়িতে করে গরু ঢাকায় পাঠালে ফেরিঘাটে বিড়ম্বনায় পড়তে হতো। পাশাপাশি ট্রলারে করে গরু নিলে ডাকাতি হতো। দীর্ঘ যাত্রাপথে অনেক সময় কিছু গরু মারা যেত। এ কারণে বেশিরভাগ সময় তিনি তার খামারের সব গরু ব্যাপারীদের কাছে বিক্রি করে দিতেন। কিন্তু এবার খামারের প্রায় দেড়শ' গরু তিনি নিজেই ঢাকায় নিয়ে যাবেন।

কুষ্টিয়ার গরুর খামারি মোসলেম উদ্দিন শেখ জানান, কোরবানির ঈদের আগে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে বিদেশ থেকে আসা তার ছোট ভাই মাঝারি মাপের একটি শেড তৈরি করে গ্রামের গৃহস্থদের কাছ থেকে অর্ধশতাধিক গরু কিনছেন। সেগুলো লালন-পালনের পাশাপাশি দুধের খামার তৈরি করার পরিকল্পনা নিয়ে বেশ কয়েক বিঘা জমি কিনেছেন। শুধু তার ছোট ভাই-ই নন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর স্বল্প সময়ের মধ্যে দুধ ঢাকাসহ অন্যান্য চাহিদাসম্পন্ন এলাকায় দুধ দ্রম্নত সরবরাহ করা সম্ভব হওয়ায় অনেকে এ খাতে নতুন করে বিনিয়োগে ঝুঁকেছেন। পুরনো খামারিরাও তাদের বিনিয়োগ বাড়িয়েছেন। যার ইতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে স্থানীয়ভাবে পড়েছে।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, ঢাকার সঙ্গে সরাসরি সংযোগ সহজ হওয়ায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহ এবং উৎপাদিত পণ্য সরবরাহ সহজলভ্য হবে- এ প্রত্যাশায় এরইমধ্যে দ্রম্নতগতিতে শিল্পায়ন-নগরায়ণের প্রসার ঘটতে শুরু করেছে। কৃষি খাতে বিনিয়োগও ধাপে ধাপে বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও ফরিদপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোতে কৃষিপণ্য উৎপাদনে অনেক নতুন বিনিয়োগকারী যোগ দিয়েছেন। ফলে সেখানকার দারিদ্র্য বিমোচনের পথ সুগম হয়ে উঠেছে।

অন্যদিকে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর আরও সচল হওয়ায় পণ্য পরিবহণের জন্য অনেকে কাভার্ড ভ্যান ও কনটেইনার ক্যারিয়ারসহ বিভিন্ন যানবাহন ক্রয়ে পুঁজি লগ্নি করতে শুরু করেছেন। এছাড়া সাগরকন্যা কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবন, ভরতভায়না, ষাটগম্বুজ মসজিদ ও খানজাহান আলীর মাজারসহ নতুন পুরনো পর্যটনকেন্দ্র দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা বাড়বে- এ প্রত্যাশায় হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট ও রেস্টুরেন্ট খাতেও নতুন বিনিয়োগ বাড়ায় এসব এলাকায় চাঙাভাব দেখা দিয়েছে।

এদিকে পদ্মা সেতুকে ঘিরে গণপরিবহণেও বড় অঙ্কের বিনিয়োগের হিড়িক পড়েছে। এরইমধ্যে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলা থেকে ঢাকায় যাতায়াতের জন্য দেশের খ্যাতনামা পরিবহণ কোম্পনিগুলোর বিলাসবহুল অর্ধশতাধিক বাস নামিয়েছে। এখাতে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় দেড়শ' কোটি টাকা। এর ইতিবাচক প্রভাবও আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর পড়ছে।

হানিফ পরিবহণের ব্যবস্থাপক রানা তালুকদার বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় নতুন করে জেগে উঠেছে ভগ্নদশায় থাকা বরিশালের পরিবহণ খাত। সেতু পাড়ি দিয়ে এখন মাত্র চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টায় বরিশাল থেকে ঢাকায় পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে। তাই যাত্রীদের আধুনিক ও বিলাসী সেবা নিশ্চিত করতে আমাদের কোম্পানি বরিশালে নতুন ১০টি বাস যুক্ত করেছে। আরও কিছু বাস এ রুটে যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে

শ্যামলী পরিবহণের জিএম আফজাল হোসেন জানান, পদ্মা সেতুকে ঘিরে তারা বরিশাল, পটুয়াখালী, কুয়াকাটা, মঠবাড়িয়া, পাথরঘাটা, বরগুনা পিরোজপুর রুটে ১৫টি নতুন বাস যুক্ত করেছেন। অর্থনীতিবিদদের পর্যবেক্ষণ, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। মানুষের আয়-রোজগার আগের তুলনায় বাড়ছে। যা দেশের সার্বিক দারিদ্র্য সূচক ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পদ্মার দুই পাড়ের মানুষের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি সামাজিক গতিশীলতাও এখন ঊর্ধ্বমুখী।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়