রাঙামাটি । মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪ , ৪ চৈত্র ১৪৩০

নিউজ ডেস্কঃ-

প্রকাশিত: ১২:১৬, ২ জুলাই ২০২২

দেশে উৎপাদিত পণ্য আমদানি নয়

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সাশ্রয়

দেশে উৎপাদিত পণ্য আমদানি নয়

ডলার সাশ্রয় করে রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে দেশে উৎপাদিত পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এ সিদ্ধান্ত বেশি কার্যকর হবে।

এ ছাড়া দেশীয় শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী যেসব পণ্য স্থানীয় উৎপাদিত হয় সেগুলোর আমদানিও নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। একই কারণে বাণিজ্যিকভাবে অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী পণ্য আমদানিতে ব্যাংকগুলো বৈদেশিক মুদ্রা ছাড় প্রায় বন্ধ রেখেছে।

সূত্র জানায়, রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে পণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন বাড়ানো হয়েছে। বিলাসী পণ্য আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু এতেও পণ্যের আমদানি ব্যয় কমেনি। বরং বেড়েই চলেছে। তবে বিলাসী পণ্যের এলসি খোলা কিছুটা কমেছে। এগুলোর আমদানি আরও কমাতে এলসি মার্জিনের হার বাড়িয়ে শতভাগ করা হচ্ছে।

বৈদেশিক সহায়তার প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অর্থ ছাড়ের শর্ত অনুযায়ী বিদেশ থেকে কিছু পণ্য আমদানি করতে হয়। অথচ ওইসব পণ্য দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। দেশি পণ্য ব্যবহার না করে বিদেশ থেকে এনে ব্যবহারের ফলে দেশি পণ্য মার খাচ্ছে।

অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। কাজেই বিদেশি সহায়তানির্ভর যে প্রকল্পে দেশে উৎপাদিত হয় এমন পণ্য বিদেশ থেকে আমদানির শর্ত রয়েছে-সেগুলো বাস্তবায়নে ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। তবে যেসব পণ্য দেশে উৎপাদিত হয় না, কেবল সেগুলো আমদানিতে কোনো বাধা নেই।

নতুন করে যেসব বৈদেশিক সহায়তানির্ভর প্রকল্প নেওয়া হবে সেগুলোতে দেশে উৎপাদিত হলে ওই পণ্য ব্যবহারের সুযোগ রেখে বিদেশ থেকে একই পণ্য আমদানির শর্ত পরিহার করতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোকে ইতোমধ্যে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ডলার সংকটের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করতেই এমন পদক্ষেপ।

এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করতে আমদানির বিকল্প পণ্য দেশে উৎপাদনের জন্য কৃষকসহ সংশ্লিষ্টদের উৎসাহিত করার পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মসলাজাতীয় পণ্য, তৈলবীজ, দুধ, কৃষি পণ্য উৎপাদনে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এসব খাতে সহজে ও কম সুদে ঋণ দিতে একটি বিশেষ তহবিল গঠন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এসব পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির বিপরীতে সরকার থেকেও বিভিন্ন প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, রিজার্ভ সাশ্রয় করতে বহুমুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এগুলো সবই সাময়িক। তবে আমদানির বিকল্প পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণের জোগান বাড়ানো হয়েছে। আরও বাড়ানো হবে। এ জন্য একটি বিশেষ তহবিলও গঠন করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, প্রতি বছর অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী পণ্য আমদানিতে ৯৭০ কোটি ডলার ব্যয় হচ্ছে যা মোট আমদানি ব্যয়ের ৪৭ শতাংশ। আমদানির ৫৩ শতাংশই ব্যয় হয় শিল্প খাতে। ১২ শতাংশ ব্যয় খাদ্যপণ্য আমদানিতে।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থনীতির আকার বড় হচ্ছে। সম্পদের বণ্টনে বৈষম্যের কারণে একটি বড় ধনিক শ্রেণিও তৈরি হয়েছে। ফলে বিলাসী পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। এগুলোর আমদানি স্থায়ীভাবে ঠেকানো সম্ভব নয়। কৃষি ও শিল্প খাতের অনেক পণ্য দেশে উৎপাদন হচ্ছে। এগুলোর ব্যবহার বাড়ালে ডলার সাশ্রয় করা সম্ভব। কোনো পণ্যের দাম হঠাৎ বেড়ে গেলেই আমদানির ঘোষণা দেওয়া হয়। এটি ঠিক নয়। বাজারে ওই পণ্যের চাহিদা, সরবরাহ ও উৎপাদন ঠিক থাকলে আমদানি না করে বাজার তদারকি করেও দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এতে ডলার সাশ্রয় হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, দেশে উৎপাদন সম্ভব এমন পণ্য প্রতি বছর আমদানি হয় ৫০০ কোটি ডলারের বেশি। ৩০০ কোটি ডলারের বেশি শুধু বিলাসী পণ্য আমদানি হয়। প্রতি বছর দেশে প্রায় ৬৮১ কোটি ডলারের ভোগ্যপণ্য আমদানি হয়। এর মধ্যে চাল ও গম ১৮১ কোটি ডলার, চিনি ও লবণ ৭৫ কোটি ডলার, দুধ ৩২ কোটি ডলার, ডাল ২৬ কোটি ডলার, পেঁয়াজ ১৬ কোটি ডলার, মসলা ৪০ কোটি ডলার, অন্যান্য পণ্য ১৫৭ কোটি ডলারের আমদানি হচ্ছে।

এসব পণ্য দেশেই উৎপাদন করা সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে পাম ও সয়াবিনের চাষ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে ভোজ্যতেল আমদানি কমানো সম্ভব হবে। পরিশোধিত ভোজ্যতেল ৯৩ কোটি এবং অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানি হচ্ছে ৫১ কেটি ডলারের। অপরিশোধিত ভোজ্যতেলের চেয়ে পরিশোধিত তেলর দাম ২০ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি। ফলে অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানি করে দেশীয় কোম্পানিতে পরিশোধ করে বাজারজাত করলে অর্ধেক অর্থ সাশ্রয় হবে বলে মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

দেশে তেলবীজ উৎপাদন বাড়িয়ে এ আমদানি কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের বীজ আমদানি হচ্ছে ৬৬ কোটি ডলারের। এ খাতেও আমদানি কমানো সম্ভব।

প্রতি বছর গড়ে বিভিন্ন ফল আমদানি হয় ৪৮ কোটি ডলারের। এর বিকল্প হিসাবে দেশে ফলের উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামালের মধ্যে ১৭ কোটি ডলারের সিমেন্ট আমদানি হচ্ছে। অথচ দেশেই চাহিদার চেয়ে বেশি সিমেন্ট উৎপাদন হচ্ছে। একই সঙ্গে রপ্তানিও হচ্ছে। পেপার ও পেপার বোর্ড দেশে উৎপাদন হচ্ছে। অথচ বছরে আমদানি হচ্ছে ২৪ কোটি ডলারের। এগুলোও আমদানি কমানো সম্ভব। দেড় কোটি ডলারের ডিজেল ইঞ্জিন আমদানি হচ্ছে। এগুলোও দেশে তৈরি সম্ভব।

দেশে টাইলসের বাজার স্বয়ংসম্পূর্ণ। বৈদ্যুতিক তার, কাঠ, সিমেন্ট, রড, এসব চাহিদা অনুযায়ী দেশে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তার পরও বিদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৫৬০ কোটি ডলার এসব পণ্য আমদানি হয়। এর মধ্যে সিরামিক টাইলস আমদানি করা হয় ৮৭ কোটি ডলারের। অথচ দেশের চাহিদা মিটিয়ে প্রতি বছর বিদেশে প্রায় ৭৭ কোটি ডলারের সিরামিক টাইলস রপ্তানি হচ্ছে। একইভাবে বিদেশ থেকে প্রতি বছর ৫৮ কোটি ডলারের সিরামিক পণ্য আমদানি করা হচ্ছে। অথচ দেশে উৎপাদিত সিরামিক সামগ্রী প্রতি বছর ৮২ কোটি ডলারের রপ্তানি করা হচ্ছে।

এর বাইরে সরকার খাদ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা সচল রাখতে বিভিন্ন সময় চাল, ডাল, গম, ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি করে থাকে। এ খাতেও বাড়তি ডলার ব্যয় হচ্ছে। দেশে উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থায় তদারকি করে এ খাতেও আমদানি কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বিলাসী পণ্যের মধ্যে বছরে গড়ে চার কোটি ডলারের পশুপাখি, ৮১ লাখ ডলারের পশুপাখির উপকরণ, ছয় কোটি ডলারের মাছ, ৩৩ কোটি ডলারের দুধ, ডিম ও মধু, ৫৫ লাখ ডলারের সবজি, কফি, চা ও মসলা আমদানি হয় ৪০ কোটি ডলারের, দুই কোটি ডলারের বাদাম, ১৭ লাখ ডলারের জুতা, ফার্নিচার ৯০ লাখ ডলারের, ছাতা আমদানি হয় ৩৭ লাখ ডলারের।

জনপ্রিয়