রাঙামাটি । বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ , ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ-

প্রকাশিত: ১৫:৩৮, ৬ আগস্ট ২০২২

আপডেট: ১৫:০৩, ৯ আগস্ট ২০২২

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলো ‘আদিবাসী’ নয় ‘উপজাতি’

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলো ‘আদিবাসী’ নয় ‘উপজাতি’

জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) কনভেনশন-১৬৯’র আর্টিক্যাল ১ অনুযায়ী উপজাতিদের জন্য আলাদা সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “একটি দেশের মূল জনগোষ্ঠী থেকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্নতর যারা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও আইন দ্বারা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পরিচলিত তাদেরকে উপজাতি বলা হয়। এখন আইএলও’র এই সংজ্ঞাটি যদি আমরা বাংলাদেশের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাঁওতাল ও অন্যান্য সাবস্পেসিসসমূহের সাথে বিচার করি তাহলে পরিষ্কার বোঝা যায় তারা উপজাতি। কেননা, ট্রাইব শব্দের বাংলা অর্থ উপজাতি। 

আইএলও কনভেনশন-১৬৯’র আর্টিক্যাল ১ এ আদিবাসীদের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে,

যুক্তরাষ্ট্রের রেড ইন্ডিয়ান, অস্ট্রেলিয়ার এবরিজিন, নিউজিল্যান্ডের মাউরি, রাশিয়ার মেনেট, জাপানের আইনু, আরবের বেদুইন প্রভৃতি জনগোষ্ঠী যারা সুপ্রাচীনকাল থেকে স্ব স্ব ভূখণ্ডে বসবাস করেছেন তারা আদিবাসী হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃত।

এখানে উল্লেখ্য যে, যুক্তরাষ্ট্রের রেড ইন্ডিয়ানগণ অষ্ট্রেলিয়ায় গিয়ে বসবাস শুরু করলে তাদের অষ্ট্রেলিয়ার আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হবে না। আভিধানিক সংজ্ঞায় আদিবাসী শব্দের প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘Indigenous’ অথবা ‘Aborigine’ যার অর্থ হচ্ছে ‘Native Born, Originating or Produced Naturally in a Country, not Imported’ যার বাংলা প্রতিশব্দ/অর্থ হচ্ছে, “আদিবাসী হতে হলে অভিবাসী হলে হবে না, বরং সত্যিকারভাবে একটি দেশে যারা প্রাচীনকাল থেকেই বাস করে আসছে তারা। অর্থাৎ বহিরাগত নয়।”

কিন্তু বাংলাদেশের এক শ্রেণির স্বার্থানেসী বুদ্ধিজীবি মহল আইএলও কনভেনশনের আর্টিকেল ১-এ উপস্থাপিত উপজাতি সংজ্ঞায় “ট্রাইবাল ডেফিনেশনটিকে সম্পূর্ণ চেপে গিয়ে শুধু ইনডিজিন্যাস পিপলের সংজ্ঞাটি উপস্থাপন করে এসব বুদ্ধিজীবি মহল বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোকে আদিবাসি হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে।

এদিকে, সকল ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক, প্রত্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর কেউই বাংলাদেশে স্মরণাতীত কাল থেকে বসবাস করছে না। তাদের সকলেই বহির্বিশ্ব বিশেষ করে ভারত, মিয়ানমার ও চীন থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বিভিন্ন সময়ে। এই অনুপ্রবেশও স্মরণাতীত কাল পূর্বে ঘটেনি। মাত্র কয়েকশ’ বছর পূর্বে ভারত ও মিয়ানমার থেকে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। উপরন্তু বাংলাদেশের এই উপজাতীয় জনগোষ্ঠী তাদের আদিনিবাস ভারত ও মিয়ানমারেও আদিবাসী জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃত নয়।

বাংলাদেশে উপজাতীয়দের আগমনের প্রেক্ষাপট

ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, দুনিয়াজুড়ে প্রতিটি জাতি-রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেই অসংখ্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বিরাজমান। তেমনি বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় চাকমা, মারমা, ‘ত্রিপুরা’ বম, গারো, হাজং, সাঁওতাল, ওরাঁও, রাজবংশী, মনিপুরী, খাসিয়া প্রভৃতি জনগোষ্ঠী রয়েছে। এদের অধিকাংশেরই বৃহত্তর অংশ রয়েছে প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারে। ক্ষুদ্রতর একটি অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে আগে-পরে বাংলাদেশে এসেছে। তবে এদের কোনোটিই বাংলাদেশের আদিবাসিন্দা বা ‘আদিবাসী’ নয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের আগমন

পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের আগমন ৪শ বছরের পূর্বে নয়। চাকমা মৌখিক ইতিহাস অনুসারে, চাকমা উপজাতিটি ভারতের ত্রিপুরার চম্পকনগর থেকে বার্মার পশ্চিমাঞ্চলীয় পার্বত্য অঞ্চল আরাকানে চলে আসে ১৫০৩ খ্রিস্ট্রাব্দে। পরবর্তীতে মিয়ানমার অঞ্চলে গোত্রীয় সংঘাতে পরাজিত হলে এই জনগোষ্ঠী আরাকান হয়ে কক্সবাজার এলাকা হয়ে চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করে ১৬০৭ সালে।

পর্তুগীজ বণিক Philip de Brito Nicote ১৬০৭ সালের এক চিঠিতে উল্লেখ করেন যে, আরাকানীদের কাছে পরাজিত হয়ে চাকমা জনগোষ্ঠী কক্সবাজার এলাকা হয়ে বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসতি স্থাপন শুরু করে। এই হিসাব অনুযায়ী বর্তমান ২০২২ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের আগমন ৪১৫ বছরের বেশি নয়।

এখানে উল্লেখ্য যে, চাকমা জনগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত হয় ব্রিটিশ আমলে। এক সময় তারা চট্টগ্রাম অঞ্চলে রাজশক্তিতেও পরিণত হয়। কিন্তু ততকালীন চাকমা রাজার নের্তৃত্বে চাকমারা পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি দখল শুরু করলে ১৮৮১ সালের দিকে ব্রিটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম কে তিনটি সার্কেলে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। এই সার্কেল গুলো হল, চাকমা সার্কেল, বোমাং সার্কেল এবং মং সার্কেল।

পার্বত্য চট্টগ্রামে মারমাদের আগমন

মারমা সম্প্রদায়ের ইতিহাসও প্রায় একই রকম। ‘মারমা’ শব্দটি ‘ম্রাইমা’ থেকে এসেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমারা মিয়ানমার থেকে এসেছে বিধায় তাদের ‘ম্রাইমা’ নাম থেকে নিজেদের ‘মারমা’ নামে ভূষিত করে। মারমারা মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত। ১৬১৪ সালে সম্রাট মাংখামাং (সম্বন্ধী) কর্তৃক মংচপ্যাইং পার্বত্য অঞ্চলের বান্দরবানে আগমন করে বসতি স্থাপন করে ১৬শ শতাব্দীতে যার ধারাবাহিকতা ছিল ১৮ শতাব্দী পর্যন্ত।

বান্দরবনের প্রয়াত সাবেক মং রাজা অংশে প্রু চৌধুরী এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমরা এই অঞ্চলে আদিবাসী নই’ আমরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। শুনুন তার বক্তব্য.....

পার্বত্য চট্টগ্রামে ত্রিপুরাদের আগমন

পার্বত্য চট্টগ্রামের তৃতীয় বৃহৎ জনগোষ্ঠী ‘ত্রিপুরা’। তারাও এসেছে পার্শ্ববর্তী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে। কথিত আছে সেখানকার রাজরোধ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর একটি ক্ষুদ্রতর অংশ ১৭০৭ সালের দিকে স্বেচ্ছানির্বাসন বেছে নিয়ে এখানে এসেছে। এর বাইরে পার্বত্য চট্টগ্রামে আছে আরও আটটি ক্ষুদ্র জাতি। তাদের কোনো কোনোটি চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাদেরও পূর্ব থেকে এই অঞ্চলে বসবাস করছে। সংখ্যায় নগণ্য হলেও তাদের পৃথক নৃতাত্ত্বিক সত্ত্বা দৃশ্যমান থাকলেও কোনোটিই বাংলাদেশের আদিবাসিন্দা বা ‘আদিবাসী’ নয়।

এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে যখন প্রথম আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদযাপন করা হয়, তখনও খোদ সন্তু লারমা বলেছিলেন এই দেশে কোন আদিবাসী নাই, এখানে আমরা সবাই উপজাতি।

দীপংকর তালুকদার এমপি বলেন, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের সময়েও সন্তু লারমাকে বলেছিলাম উপজাতির পরিবর্তে আদিবাসী বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে ফেলতে, কিন্তু তখনও সন্তু লারমা রাজি হননি। তখনও সন্তু লারমা বলেছিলেন আমরা আদিবাসী নই, আমরা উপজাতি।

দীপংকর তালুকদার বলেন, ‘অথচ জুম্ম জনগণকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্যই সন্তু লারমা এই আদিবাসী দিবস পালন করে আসছে।

-সূত্র:- দৈনিক পূর্বকোন, দীপংকর তালুকদার, ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর

অপরদিকে, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিশেষ উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকালে চাকমা সার্কেল চীফ রাজা ব্যরিস্টার দেবাশিষ রায় রাষ্ট্রীয়ভাবে অফিসিয়ালি লিখেছেন, ‍“বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নাই, কিছু জনগোষ্ঠী আছে উপজাতি।”

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভূরাজনীতি বিশ্লেষক প্রফেসর ড, আবদুর রব বলেছেন, এদেশে ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠী উপজাতীয় জাতিসত্তাগুলো আমাদেরই অংশ, বাংলাদেশের নাগরিক, বাংলাদেশী। এদেশের সম্পদে-সম্মানে, বিপদে-সুদিনে, সমৃদ্ধিতে-সৌহার্দ্যে সবকিছুতেই তাদের রয়েছে সমান অধিকার। কিন্তু তারা কোনোক্রমেই এদেশের আদিবাসী হতে পারে না। এটা নিতান্ত অবৈজ্ঞানিক ও ভুল তত্ত্ব। এদেশের স্বার্থানেসী জ্ঞানপাপীদের জানিয়ে দেয়া উচিত, কারা উপজাতি আর কারা আদিবাসী।’

বাংলাদেশে ‘আদিবাসি’ শব্দ ব্যবহার বন্ধে প্রজ্ঞাপন জারি

গত ১৯ জুলাই তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রনালয় কর্তৃক জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে, ‘বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন ক্ষুদ্র সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে উপজাতি বা ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা বা নৃ-গোষ্ঠী বলে অভিহিত করা হয়েছে। দেশে বসবাসরত বিভিন্ন উপজাতীয় সম্প্রদায়কে কোনো অবস্থাতেই ‘উপজাতি’র পরিবর্তে ‘আদিবাসী’ হিসেবে উল্লেখ না করার বিষয়ে সংবিধানে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।’

এর পরিপ্রেক্ষিতে গণমাধ্যমে সংবিধান পরিপন্থী ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার বন্ধে পূর্বেই সচেতন থাকতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।’ এমনকি কেউ যদি ‘উপজাতি’র পরিবর্তে ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার করে সে সংবিধান লঙ্গনকারী হিসেবে চিহ্নিত হবে এবং তার বিরুদ্ধে রাস্ট্র আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।

তাই ইতিহাসের সততার স্বার্থে কোন প্রকার ধূম্রজাল সৃষ্টি হতে দেয়া উচিৎ নয়। উপরে বর্ণিত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলো ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটেই বাংলাদেশের ‘আদিবাসী’ নয় ‘উপজাতি’।
 

জনপ্রিয়