রাঙামাটি । শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ , ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নিউজ ডেস্কঃ-

প্রকাশিত: ১৪:২১, ২ ডিসেম্বর ২০২২

পার্বত্য চট্টগ্রাম: বিচ্ছিন্নতাবাদের বর্তমান প্রবণতা

পার্বত্য চট্টগ্রাম: বিচ্ছিন্নতাবাদের বর্তমান প্রবণতা
​​​​​​​ছবি: প্রফেসর ড. মো. আবদুর রব

পাহাড়-পর্বত ও সবুজ বনজঙ্গলে ঘেরা অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সমগ্র দেশের ভূখণ্ডের এক-দশমাংশ এই পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের জন্য ভূরাজনৈতিক দিক দিয়ে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি অনাহরিত সম্পদের বিশাল ভাণ্ডার হিসেবেও সম্ভাবনাময়। কিন্তু একইসাথে তা বহু সমস্যায় আকীর্ণও বটে। পুরো অঞ্চলটি দুর্গম হওয়ায় বাকি বাংলাদেশের সাথে অঞ্চলটির যোগাযোগ ও অঞ্চলটিতে সরকারের অভিগম্যতা ততটা স্বাচ্ছন্দ্যময় নয়। সেই সাথে যোগ হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই এ অঞ্চলে শুরু হওয়া বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগ্রাম। এহেন পরিস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের সামনে একইসাথে সম্ভাবনার অপার দুয়ার ও কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাজির হয়েছে।

ভৌগোলিক অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উত্তর-পশ্চিমাংশ, দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বাংশে এবং বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশে প্রায় 21o 25’ থেকে 23 o 45’ উত্তর অক্ষাংশ এবং 91o 54’ থেকে 92o 50’ ভৌগোলিক অবস্থানের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম (Chittagong Hill Tracts) অবস্থিত। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত তিনটি প্রশাসনিক জেলার সমন্বয়ে গঠিত। জেলাগুলো হচ্ছে: বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি। এ তিনটি জেলা মিলে পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট আয়তন ১৩১৮৪ বর্গ কি.মি.।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্বে ভারতের মিজোরাম প্রদেশ, দক্ষিণে মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশ, উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা প্রদেশ এবং পশ্চিমে চট্টগ্রাম অবস্থিত। ভৌগোলিকভাবে ফেনী, সাঙ্গু, মাতামুহুরি, কর্ণফুলী নদী এবং তাদের কিছু উপ ও শাখানদী পার্বত্য চট্টগ্রামকে মোটাদাগে চারটি উপত্যকা অঞ্চলে বিভক্ত করেছে। এ উপত্যকাগুলো হচ্ছে চেঙ্গী উপত্যকা, কাসালং উপত্যকা, রাইনখিয়াং উপত্যকা ও সাঙ্গু উপত্যকা। এসব উপত্যকার সমান্তরালে উত্তর-দক্ষিণে প্রসারিত কয়েকটি দীর্ঘ ও মাঝারি আকারের পাহাড় অবস্থিত। কয়েকশ’ মিটার থেকে শুরু করে ১০০০ মিটারেরও বেশি উচ্চতার পর্বত শ্রেণীর দেখা মেলে পার্বত্য চট্টগ্রামে (যেমন ১০০৪ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট মওডাক মুয়াল)।

পার্বত্য চট্টগ্রামের নদীগুলোও নদী অববাহিকা উপত্যকার মতো পারস্পরিক সমান্তরালভাবে উত্তর-দক্ষিণে প্রসারিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল নদীগুলো হচ্ছে ফেনী, কর্ণফুলী, সাঙ্গু, মাতামুহুরি ইত্যাদি। এসব নদীগুলোর অধিকাংশই পর্বতমালাসমূহের মধ্যবর্তী অববাহিকা ও উপত্যকার মধ্য দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে একেবারে শেষের দিকে পশ্চিম দিকে বাঁক ঘুরে বঙ্গোপসাগরের সাথে মিলিত হয়েছে। কর্ণফুলী, ফেনী এবং মাতামুহুরী নদী পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলকে চট্টগ্রামের সমতল ও বঙ্গোপসাগরের সাথে যুক্ত করেছে। এসব নদীর অববাহিকার কোলেই গড়ে উঠেছে খাগড়াছড়ি, দিঘীনালা, চন্দ্রঘোনার মতো উল্লেখযোগ্য শহর। অত্যন্ত খরস্রোতা ও গভীর অববাহিকা সম্পন্ন হওয়ায় এই নদীগুলো জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রচন্ড উপযোগী। এজন্যই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবহারের উদ্দেশ্যে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে কৃত্রিমভাবে ৪০০ বর্গ কি.মি. আয়তনের কাপ্তাই হ্রদ তৈরি করা হয়। জলবায়ুগত দিক দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ক্রান্তীয় বৃষ্টিবহুল চিরহরিৎ উদ্ভিজ্জ মণ্ডলীর উষ্ণতা প্রধান অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। এ অঞ্চলে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ২৫০ সে.মি.। পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট ভূমির অর্ধেকেরও বেশি অংশ বনাচ্ছাদিত পাহাড়ি অঞ্চল। এই বনাঞ্চলের মোট পরিমাণ ৭০৪৬ কি.মি.।

ইতিহাস: পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাচীন ইতিহাস এখনো অনাবিষ্কৃত। ধারণা করা হয়, হাজার বছর আগে এই গভীর অরণ্যাবৃত অঞ্চলে কিছু ভ্রাম্যমাণ জংলি জনগোষ্ঠির পদচারণা ছিল, যারা বন্য প্রাণী শিকার ও ফলমূল সংগ্রহের মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করত। এ অঞ্চলের সাথে সমতলের যোগাযোগ শুরু হয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে। সেসময় কয়েকটি অরণ্য উপজাতি গোষ্ঠি (যেমন: কুকি জনধারাভুক্ত ম্রো, পাংখো, খুমি, লুসাই ইত্যাদি) এ অঞ্চলের অরণ্যে বিচরণ করত। ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগীজ মানচিত্রকার লাভানহা কর্তৃক অঙ্কিত বঙ্গের প্রথম প্রকাশিত মানচিত্রে এই অঞ্চলের উল্লেখ পাওয়া যায়। অবশ্য এর অনেক আগে ৯৫৩ সালে আরাকানের এক রাজা পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান জেলাসমূহ ও চট্টগ্রাম দখল করেন। পরবর্তীতে ১২৪০ সালে ত্রিপুরার রাজা এই অঞ্চল দখল করেন। আরাকানের রাজা ১৫৭৫ সালে জেলাগুলো পুনরায় দখল করে নেন এবং ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত দখল বজায় রাখেন। এ সময়কালে এবং এর পর থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চল থেকে মারমা, চাকমা এবং উত্তরের ত্রিপুরা অঞ্চলে থেকে আগত ত্রিপুরা জনগোষ্ঠির আগমন ঘটতে থাকে। এদের বেশিরভাগই নিজ মাতৃভূমি থেকে এ অঞ্চলে দেশান্তর করেন যুদ্ধ বা অন্য কোনো কারণে বিতাড়িত হওয়ার কারণে। এ জনগোষ্ঠিসমূহ অনেক সময়ই পরস্পরের প্রতি বৈরীভাব বজায় রাখত এবং প্রায়শঃই যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হতো। মোঘলরা ১৬৬৬ থেকে ১৭৬০ সাল পর্যন্ত অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ করে। ১৭৬০ সালে এলাকাটির কর্তৃত্ব মীর কাসেম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে হস্তগত করেন। ব্রিটিশরা ১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম দখল করে একে ব্রিটিশ ভারতের অংশে পরিণত করে। তারা এর নামকরণ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম (চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস)। ব্রিটিশরা পার্বত্য চট্টগ্রামকে চট্টগ্রামের সম্প্রসারিত অংশ হিসেবে নথিভুক্ত করে। দক্ষিণের পাহাড় পার্বত্য আরাকান ও উত্তরের পাহাড় পার্বত্য ত্রিপুরা রূপে পরিচিত হয়। প্রশাসনিকভাবে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে বঙ্গ প্রদেশের অধীনে নিয়ে আসে। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধিতে হেডম্যান ও প্রধানদের নেতৃত্বে কর আদায়ের একটি স্থানীয় ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়।

১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর স্বাভাবিকভাবেই সাবেক পূর্ব-পাকিস্তানের অংশ হিসেবে এটি বাংলাদেশের অংশে পরিণত হয়। এর পর এ অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ও উন্নয়ন কার্যক্রমের সূচনা হয়। আশির দশকের প্রথম দিকে দেশব্যাপী প্রশাসনিক সংস্কারের অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটি স্বতন্ত্র জেলায় বিভক্ত করা হয়। এগুলো হচ্ছে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তিটির মাধ্যমে ঐ অঞ্চলে দুই দশকব্যাপী সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম হ্রাস করার মাধ্যমে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করা হয়।

জনমিতি: ২০২২ সালের জনশুমারী অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট জনসংখ্যা ১৮৪২২১৫ জন, যাদের মধ্যে বাঙ্গালী ৯২২৫৯৮ জন (৫০.০৬%) এবং অবাঙ্গালী/ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি ৯২০২১৭ জন (৪৯.৯৪%)। এই জনসংখ্যার মধ্যে মুসলিম ৮২০৪৯৮ জন (৪৪.৫২%), বৌদ্ধ ৭৬৯২৭৯ জন (৪১.৭৪%), হিন্দু ১৬৯০৯৬ জন (৯.১৮%) এবং খ্রিস্টান ৬০০২৮ জন (৩.২৬%) এবং অন্যান্য ধর্মের অনুসারী ২৪০৩৪ জন (১.৩০ %)। পার্বত্য চট্টগ্রামে ১১টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির বসবাস। জনসংখ্যার অধঃক্রমানোসারে এসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির জনসংখ্যা ও (বাংলাদেশের সকল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির সাপেক্ষে) শতকরা হার নিচে দেয়া হল:

চাকমা ৪৮৩,২৯৯ (২৯.২৯%), মারমা ২২৪,২৬১ (১৩.৫৯%), ত্রিপুরা ১৫৬,৫৭৮ (৯.৪৯%), ম্রো/মুরং ৫২,৪৫৫ (৩.১৮%), তঙ্গঞ্চা ৪৫,৯৭২ (২.৭৯%), বম ১৩,১৯৩ (০.৮০%), খিয়াং ৪,৮২৬ (০.২৯%), খুমি ৩৭৮০ (০.২৩%), চাক ৩,০৭৭ (০.১৯%), পাংখোয়া/পাংখো ১৮৫৭ (০.১১%), লুসাই ৩৮০ (০.০২%)।

অধিকাংশ চাকমা ও মারমা বৌদ্ধধর্ম পালন করে, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠি হিন্দু ধর্মের আর মিজো, বম ও থেয়াং খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। অন্য কিছু গোত্র আত্মা, প্রাণী ও উদ্ভিদের পূজারী। পার্বত্য চট্টগ্রামে মানব বসতি স্থাপনের বিন্যাসে এলাকাভিত্তিক মেলামেশার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। কিছু গোষ্ঠি কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে বিশিষ্ট হয়ে ওঠে (যেমন চাকমারা পার্বত্য চট্টগ্রামের কেন্দ্রে এবং মারমারা সাঙ্গু ও কর্ণফুলি নদীর অববাহিকায়), আবার অন্যরা কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় কেন্দ্রীভূত থাকে (যেমন ত্রিপুরারা উত্তরে ও মুরোরা দক্ষিণে)। পাহাড়ের উপত্যকায় বসবাসকারী গোষ্ঠি ও পাহাড়ের চূড়ায় বসবাসকারী গোষ্ঠির ভিতরেও পার্থক্য আছে। অর্থাৎ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আঞ্চলিক বসতি স্থাপনের বিন্যাসটি অত্যন্ত জটিল।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সম্পদ সম্ভাবনা: পার্বত্য চট্টগ্রামের বিপুল ভূমি-সম্পদ, অপরিমেয় ও প্রায় অব্যবহৃত পানি সম্পদ, মূল্যবান বনজ সম্পদ এবং সম্ভাবনাময় অনাবিষ্কৃত কিংবা অনাহরিত খনিজ সম্পদ এ অঞ্চলকে পুরো বাংলাদেশের জন্য ব্যাপক সম্ভাবনাময় করে তুলেছে।

ভূমিসম্পদ: ২০২২ সালের জনশুমারী অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রায় ১৫৮ জন/বর্গ কি.মি.। অন্যদিকে এর আশেপাশের সমতল জেলা চট্টগ্রামে গড়ে প্রতি বর্গ কি.মি.-তে ৯৭৯ জন বাস করে। আর তাই বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার স্থান সংকুলানের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের কমবসতিপূর্ণ উপত্যকা ও অববাহিকাগুলো একটি কার্যকর সমাধান হিসেবে হাজির হতে পারে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩য় ভাগের ৩৬ ও ৪২ নাম্বার অনুচ্ছেদে দেশের যেকোন জনগণকে দেশের যেকোন স্থানে যাতায়াত, বসতিস্থাপন, জমি ক্রয় ও সম্পত্তি গড়ে তোলার মৌলিক অধিকার দেয়া হয়েছে। এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূসম্পদসহ যেকোন সম্পদের উন্নয়ন, আহরণ, ব্যবহার-বাণিজ্য এবং বিনিময়ের আইনসম্মত অধিকার দেয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের চেঙ্গী ভেলী, সাঙ্গু ভেলী, মাতামুহুরী ভেলী, মাইনী ভেলী এবং কাসালং ভেলীসহ প্রভৃতি দীর্ঘ ও প্রশস্ত উপত্যকায় বর্তমান জনসংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি (৫০ লক্ষ) জনসংখ্যার স্থান সংকুলান ও জীবিকার ব্যবস্থা করা সম্ভব। তাছাড়াও উর্বর ও যথেষ্ট জৈবসার মিশ্রিত পার্বত্য ঢালে ফিলিপাইন, জাভা কিংবা হাওয়াইর মতো ধাপ বা ‌‘Terrace’ কেটে ক্রান্তীয় বৃষ্টিবহুল পার্বত্য বৃষ্টি ব্যবস্থার মতো যথোপযুক্ত পদ্ধতি ব্যবহার করে অনায়াসেই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিপুল বন্ধুর ভূমিরূপকে অনুকূল ও কয়েকগুণ ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন উপযুক্ত ভূমিতে পরিণত করা সম্ভব। পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি, দিঘীনালা, বান্দরবান অথবা প্রলম্বিত দীর্ঘ উপত্যকাগুলোর বিভিন্ন স্থানে ছোট ও মাঝারী আকারের শিল্প নগরী বা পর্যটন উপশহর গড়ে তোলা যেতে পারে।

কৃষিসম্পদ: পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল ‘অ’ (0 to 0.5% slope), ‘ই’ (20% slope) এবং ‘ঈ’ (40% slope) মানের ভূমিকে কোনো না কোনো কৃষি কাজের আওতাভুক্ত করা যায়। ‘অ’ শ্রেণীভুক্ত ভূমির পরিমাণ কম হলেও সেগুলোতে ফলন খুব ভালো হয় এবং এগুলোতে কৃষিকাজের মাত্রা বাড়ানো যেতে পারে। ‘ই’ শ্রেণীর উঁচু-নিচু জমির ঢাল ঝুম চাষপদ্ধতি এবং সবজি ও ফলমূল চাষের জন্য লাগসই। ‘ঈ’ শ্রেণীভুক্ত পাহাড়ি জমি অধিক উঁচু ও খাড়া ঢালসম্পন্ন হওয়ার কারণে এসব জমিতে ধাপ বা টেরেসিংয়ের মাধ্যমে গম, ভুট্টা, ধান এবং অন্যান্য সবজি ও মসলার চাষ করা যেতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্ররামের পাহাড়ি জমিতে ভালো কাজু বাদাম চাষ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এগ্রোফরেস্ট্রি (Agro-Forestry) বা কমিউনিটি ফরেস্ট্রি (Community-Forestry) ইত্যাদি আধুনিক বনায়ন পদ্ধতির দ্বারা গাছপালার সংখ্যা বাড়াতে হবে। গভীর বনাঞ্চলে বড় বড় বৃক্ষের নিচে পাহাড়ি জমিতে নানাধনের খাদ্যভুক্ত ‘কন্দ’ বা ‘মূল’ জাতীয় ফসল বিপুল পরিমাণে উৎপন্ন হতে পারে, যেগুলোর খাদ্যমানও অনেক বেশি।

মৎস্য সম্পদ: পার্বত্য চট্টগ্রামে কৃত্রিমভাবে নির্মিত জলাধার কাপ্তাই লেকে বিপুল মৎস্য চাষের সুযোগ রয়েছে। উপযুক্ত বৈজ্ঞানিক মৎস্য চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করলে মোট প্রায় ১০০০০০০ মণ বার্ষিক মাছ আহরণ করা সম্ভব। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় ১০০০ একর জুড়ে ২০০০০ ছোট ও মাঝারি আকারের পুকুর রয়েছে, যেগুলোতে অনায়াসেই ২০/৩০ হাজার মণ মাছের চাষ করা যেতে পারে। এছাড়া উল্লেখযোগ্য পাহাড়ি নদীগুলোতেও প্রচুর উপযুক্ত মাছের চাষ করা যেতে পারে।

বনসম্পদ: পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট বনাচ্ছাদিত ভূমির আয়তন ৭০৪৩.৮৬ বর্গ কি.মি., যার মধ্যে ১৫৩৮ বর্গ কি.মি. সংরক্ষিত বনভূমি এবং বাকি প্রায় ৫৪৫২.৫০ বর্গ কি.মি. অশ্রেণীভুক্ত, যার বেশিরভাগ বৃক্ষরাজি উজাড় হয়ে ঝোপঝাড়ে পরিণত হয়েছে বা নতুন বনায়নের আওতাধীন রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে কাঠ ও বাঁশ-বেত ছাড়াও অন্যান্য অনেক সম্পদের সম্ভাবনা রয়েছে। শিল্পের কাঁচামাল, বাড়ি-ঘর, আসবাবপত্র তৈরিতে কাঠ, ঔষধ ও খাদ্য সামগ্রীর জন্য অপরিহার্য যোগানস্থল হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। পার্বত্য চট্টগ্রামের বনভূমি সমস্ত বাংলাদেশের বনভূমির অর্ধেকেরও বেশি হওয়ার কারণে এর অস্তিত্বের সাথে বাংলাদেশের পরিবেশগত স্বাস্থ্য নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত।

খনিজসম্পদ: খাগড়াছড়ি জেলায় অবস্থিত সেমুতাং গ্যাসক্ষেত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র গ্যাসক্ষেত্র। ১৯৬৯ সালে ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি (তৎকালীন পাকিস্তানের Oil and Gas Development Corporation) এটি আবিষ্কার করে। তৎকালীন হিসাব অনুযায়ী আহরণযোগ্য গ্যাসের মজুদ ছিল ০.১৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। এছাড়াও বান্দরবন জেলার রুমা থানার ঘেরাউ এলাকায় প্রাকৃতিক গ্যাস, আলীকদম থানার তৈল মৌজায় পেট্রোলিয়াম এবং লামা থানার চলম ঝিলিতে প্রচুর কয়লা সম্পদ রয়েছে। বাঘাইছড়ি ও কাপ্তাই থানায় প্রচুর পেট্রোলিয়াম রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। ১৯৮১ সালের শেল ওয়েল কোম্পানি বাঘাইছড়ি থানায় খনিজ তেলের সন্ধান পায়, কিন্তু শান্তি বাহিনীর সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের ফলে উক্ত কাজ বন্ধ হয়ে যায়। বান্দরবানের অন্যান্য প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে বেলেপাথর, গন্ডশিলা, ক্যালকেরিয়াস কনক্রিশন, কংগ্লোমারেট ও লিগনাইট কয়লা।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব: পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূরাজনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান থেকেই তা স্পষ্ট। পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থান দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মিলনস্থলে এবং ভারত মহাসাগরের প্রবেশ পথে বঙ্গোপসাগরের উপকূল থেকে কয়েক কি.মি. দূরে। এ অঞ্চলে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদের সমাহার। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠি অন্তর্ভুক্ত কিছুলোক বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী ও ধ্বংসাত্মক তৎপরতা সাথে যুক্ত। এছাড়াও এ অঞ্চলের সীমান্ত সংলগ্ন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মিজোরাম, মনিপুর, নাগাল্যান্ড, আসাম ও মিয়ানমারের আরাকান, শান, কোচিন ও চিন প্রভৃতি প্রদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ ভারত ও মিয়ানমারের উপরোল্লিখিত অঞ্চলের উপজাতি জনগোষ্ঠিগুলোর সবাই মঙ্গোলীয়, তিব্বতী ও বর্মী জাতিতাত্ত্বিক ধারার অন্তর্ভুক্ত। ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের অনুপবর্তী পশ্চাৎভূমি হিসেবে এবং চীন, ভারত আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আসিয়ানভুক্ত অর্থনৈতিক শক্তির প্রায় সমদূরবর্তী প্রভাব-ভূমি হওয়ায় এশিয়ার এই ত্রিভুজ ভূভাগটি ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় হলেও, কৌশলগত দিক দিয়ে খুবই অসুবিধাজনক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। সমস্ত পার্বত্য অঞ্চলটির সন্নিহিত অবস্থান খুবই প্রতিকূল। একমাত্র পশ্চিমে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল ছাড়া এলাকাটির উত্তর-পূর্ব কিংবা দক্ষিণ-পূর্বাংশের ভারত ও মিয়ানমারের অন্তর্ভুক্ত সকল প্রতিবেশী অঞ্চলসমূহ অত্যন্ত দুর্গম, পার্বত্য, বনাবৃত এবং জনবিরল অনুন্নত ভূভাগের সমষ্টিমাত্র। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি উত্তর-পূর্ব দিকে ভারতের মিজোরাম, মনিপুর, নাগাল্যান্ড আসাম ছাড়িয়ে ৬৫০ কি.মি. দূরে চীনের ইউনান প্রদেশের সীমান্ত অবস্থিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলার সাথে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের প্রায় ১১০ কি.মি. সীমান্ত রয়েছে। পার্বত্য রাঙ্গামাটির ২৪০ কি.মি. সীমানা ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের বিভক্তি নির্দেশ করে এবং পার্বত্য বান্দরবানের সাথে মিয়ানমারের রয়েছে ১৫৫ কি.মি. সীমান্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামের অসংবদ্ধ আকৃতি, প্রস্থের তুলনায় দৈর্ঘ্য কয়েকগুণ বেশি হওয়া এবং পার্বত্য চট্টগ্রামসহ, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চলসমূহ বাংলাদেশের বৃহত্তর ভূভাগের সাথে দুর্বলভাবে সংযুক্ত অভিক্ষেপিত ভূভাগ হওয়া এ ভূরাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যসমূহকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূরাজনৈতিক দুর্বলতার দিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবন জেলার নাইখ্যংছড়ি থানার শেষ প্রান্ত (পূর্বাংশ) থেকে নিকটতম সমুদ্র উপকূল মাত্র ১৩-১৪ কি.মি. দূরে অবস্থিত, যা পুরো পার্বত্য অঞ্চলটিকে বিশেষ ভূকৌশল গুরুত্ব দান করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বমোট আয়তন ১৩,১৪৮ বর্গ কি.মি., যা লেবানন, সাইপ্রাস, ব্রুনাই, কাতার কিংবা লুক্সেমবার্গের আয়তনের চেয়েও বড়। পার্বত্য রাঙ্গামাটির পশ্চিম প্রান্তের কাউখালী থেকে মাত্র ৩০ কি.মি. দূরে বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামের অবস্থান এবং কাপ্তাই থেকে ৫০ কি.মি. দূরে বঙ্গোপসাগরের উন্মুক্ত জলরাশির গভীর সমুদ্রের শুরু। পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্যে দিয়ে বাহিত কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত চট্টগ্রাম বন্দরের নাব্য এবং সমস্ত চট্টগ্রামের বন্দর, কলকারখানা, নগরীসহ সমস্ত জেলা, পার্শ্ববর্তী কক্সবাজার, ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর এবং চাঁদপুর জেলাসমূহে বিদ্যুৎ সরবরাহ এই কর্ণফুলী নদীর ওপর নির্ভরশীল। তাছাড়া নৌ-পরিবহন এবং কৃষির জলসেচ ব্যবস্থার জন্য কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলাদ্বয় পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রবাহিত কর্ণফুলী, সাঙ্গু, মাতামুহুরী, হলদিয়া ইত্যাদি নদীর উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। এভাবে দেখা যায় যে, সমস্ত চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলাদ্বয়ের প্রায় সোয়া কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা তথা অস্তিত্ব এবং বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের অস্তিত্বও বিদ্যুৎ সরবরাহের অন্যতম উৎস পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে জড়িত। এসব দিক বিবেচনায় বাংলাদেশের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূরাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক গুরুত্ব সহজেই অনুধাবন করা যায়। তাছাড়া দুর্গম এবং পর্বতঘেরা অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম সমতল চট্টগ্রামের বন্দর, মহানগর ও অপেক্ষাকৃত অপ্রশস্ত চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার ভূভাগকে ভূরাজনৈতিক এবং অবস্থানগত দুর্ভেদ্যতা দান করেছে। সংক্ষেপে বলা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিনতায় চট্টগ্রাম অঞ্চল, কৌশলগতভাবে অপেক্ষাকৃত বেশি সহজভেদ্য এবং কৃশকায় হয়ে যায়, যা রণকৌশলগতভাবে ঐ এলাকাকে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত দুর্বল ও প্রতিকূল বৈশিষ্ট্য দান করবে।

বাংলাদেশের স্বার্থ: পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে বাংলাদেশের অস্তিত্বের স্বার্থ জড়িত। পার্বত্য চট্টথাম বাংলাদেশের এক-দশমাংশ। জনভারাক্রান্ত ক্ষুদ্র আয়তন বিশিষ্ট বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান ভবিষ্যৎ বিপুল জনসংখ্যার পুনর্বাসনের জন্য অত্যন্ত কম জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই অঞ্চলটি অতীব প্রয়োজনীয় এবং অপরিহার্য। প্রাকৃতিক সম্পদের দিক দিয়েও এই পার্বত্য অঞ্চলটি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য চরম সম্ভাবনাময়। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং সমৃদ্ধ বনাঞ্চল, জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় উৎস, ফলমূল উৎপাদনের উপযোগী ক্ষেত্র এবং অনাহরিত-অনাবিষ্কৃত খনিজ সম্পদের সম্ভাবনা পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের জন্য অতি-প্রয়োজনীয় অঞ্চলে পরিণত করেছে। ভূরাজনৈতিকভাবে অঞ্চলটি বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরসহ দ্বিতীয় বৃহত্তম মহানগরী ও প্রায় সোয়া এক কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত চট্টগ্রাম অঞ্চলকে (কক্সবাজারসহ) কৌশলগত নিরাপত্তা বা ভূরাজনৈতিক আড়াল ও গুরুত্ব দান করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আড়াল ছাড়া সম্পূর্ণ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল এক ফালি সরু প্রলম্বিত সহজভেদ্য ভূমিতে পরিণত হবে। চট্টগ্রামের প্রায় সকল নদ-নদী পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার ফলে এই অঞ্চলটির বিচ্ছিন্নতা বৃহত্তর চট্টগ্রাম (কক্সবাজার জেলাসহ) অঞ্চলের কৃষি জমির পানি সরবরাহ, নৌ-যোগাযোগ, চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের নাব্য এবং কাপ্তাই হতে সরবরাহকৃত জলবিদ্যুতের অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত করে তুলবে। সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারি প্রায় সোয়া নয় লক্ষ বাংলাভাষী গরিব এবং মধ্যবিত্তের অস্তিত্বও অঞ্চলটিতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নের সাথে জড়িত।

পার্বত্য চট্টগ্রামে মিয়ানমারের স্বার্থ: বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে মিয়ানমারের সীমান্ত ১৭০ কি.মি.। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠির বেশিরভাগই কয়েক শতাব্দী আগে মিয়ানমার থেকে দেশান্তরী হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আগমন করে। এজন্যই এ অঞ্চলের বিভিন্ন উপজাতি জনগোষ্ঠির সাথে মিয়ানমারের উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিমাংশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠির অনেক সাদৃশ্য দেখা যায়। মিয়ানমারের উপরোল্লিখিত অংশে কারেন, রোহিঙ্গা, শান, চিন ইত্যাদি উপজাতি জনগোষ্ঠি কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে স্বাধিকারের জন্য লড়াই করছে। এছাড়াও এসব অঞ্চলে কম্যুনিস্ট গেরিলাদের তৎপরতাও দেখা যায়। নিপীড়নের দরুণ প্রায় ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়াও সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের সাথে সীমান্ত অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে সংঘর্ষকালে মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান ও নিক্ষিপ্ত গোলা বেশ কয়েকবার সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এসব কিছু নিয়ে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়। মিয়ানমারকে নিজের অস্তিত্বের স্বার্থেই পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারতের স্বার্থ: পার্বত্য চট্টগ্রামে রয়েছে ভারতের ব্যাপক স্বার্থ। ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধে চীন মাত্র ২/৩ দিনের মধ্যেই বৃহত্তর আসামের উত্তরাংশ তথা ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তরাংশ দখল করে নিলে, ‘সেভেন সিস্টারস’ নামক বিখ্যাত অঞ্চলে ভারতের ভূকৌশলগত দুর্বলতা ধরা পড়ে। তাছাড়া এ অঞ্চলের সাতটি প্রদেশ তথা আসাম, অরুণাচল, মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, ত্রিপুরাতে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গেরিলা আন্দোলন চলমান। ভারতের জন্য ঐসব দূরবর্তী রাজ্যসমূহে দ্রুত সরবরাহ পাঠানো ও যোগাযোগ স্থাপন করা বেশ কঠিন। যদি ভবিষ্যতে নেপাল, বাংলাদেশ বা চীন ভারতের মূল ভূখন্ডের সাথে সমগ্র উত্তর পূর্বাংশের ‘সেভেন সিস্টার্স’-এর সংযুক্তকারী সংকীর্ণ শিলিগুড়ি করিডোর বন্ধ করে দেয় তাহলে ভারত হয়তো সেভেন সিস্টার্সের উপর আধিপত্য হারাবে। এ জন্য ভূপরিবেষ্টিত ‘সেভেন সিস্টার্সে’র সাথে সমুদ্রপথের সংযোগ ঘটানোর জন্য বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর অথবা ঐ উপকূলের কোনো সুবিধাজনক স্থানকে কেন্দ্র করে সোজা উত্তর-পূর্ব দিকের ভূখণ্ড পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে মিজোরাম বা ত্রিপুরা রাজ্যের সংযোগ ঘটানোর চিন্তা করা ভারতের জন্য খুবই স্বাভাবিক। প্রযুক্তিতে অগ্রসরমান ভারত বঙ্গোপসাগরের অগভীর দক্ষিণ চট্টগ্রাম উপকূলে ভাসমান বন্দর প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের মাত্র ১৩/১৪ কি.মি. ভূমি অতিক্রম করে পার্বত্য চট্টগ্রামে পৌঁছাতে সক্ষম। তাই ভারতের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর আধিপত্য কায়েম করা পরম আকাক্সিক্ষত। ভারতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকেও ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করতে হলে ইউনান সীমান্ত থেকে মাত্র ৬০০/৬৫০ কি.মি. পার হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্য দিয়ে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করতে হবে, যা রুখতে ভারত সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। তাই চীনের আগেই ভারত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে অভিগম্যতা কায়েম করতে আগ্রহী।

পার্বত্য চট্টগ্রামে চীনের স্বার্থ: এশিয়ার প্রধান শক্তি চীন ভারত মহাসাগরে নিজের উপস্থিতি কায়েম করতে চায়, কিন্তু এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এশিয়ায় চীনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত। ভারত ১৩২টি যুদ্ধজাহাজ, ২২০টি যুদ্ধবিমান ও ১৫টি সাবমেরিন নিয়ে ইতোমধ্যেই ভারত মহাসাগরে জোরালো অবস্থান নিয়েছে। ভারত মহাসাগরের নীল জলরাশিতে প্রবেশ করতে হলে চীনের জন্য নিকটতম সংযোগ পথ হচ্ছে তিব্বতের দক্ষিণ-পূর্বাংশের ভুটানের সীমান্ত সংলগ্ন চুম্বি উপত্যকা থেকে মাত্র ৬০ মাইল বা প্রায় ১০০ কি.মি. দক্ষিণের দার্জিলিং-শিলিগুড়ি পেরিয়ে বাংলাদেশে (উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর অঞ্চল) অবতরণ পূর্বক আরও প্রায় ৫০০-৬০০ কি.মি. সমতল ভূমি পেরিয়ে মংলা বা ৭০০-৮০০ কি.মি. দূরের চট্টগ্রাম বন্দরের সুবিধা লাভ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে চীনকে ভারতের সাথে মোকাবেলা করতে হবে। আর বিজাতীয় সংস্কৃতির চীনাদের বাংলাদেশিরাও বেশিদিন আতিথেয়তা দেখাবে বলে মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে চীনকেও অপেক্ষাকৃত কম ঝামেলায় স্থায়ীভাবে ভারত মহাসাগরের প্রবেশদ্বারে পৌঁছাতে হলে মায়ানমারের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত ইউনান প্রদেশ থেকে যাত্রা করে সোজা দক্ষিণ-পশ্চিম এবং পরবর্তীতে পশ্চিম হয়ে প্রায় ৯০০ কি.মি. অত্যন্ত দুর্গম পার্বত্য এবং বনাবৃত জনবিরল মায়ানমার ও ভারতের উত্তর-পূর্ব ভূভাগ অতিক্রম করে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করতে হবে। এখান থেকে সহজেই মাত্র ৫০-৬০ কি.মি. দূরে চট্টগ্রাম বন্দর বা দক্ষিণে আরো কম দূরত্বে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে পৌঁছতে পারবে। এ ক্ষেত্রে মায়ানমার, ভারত এবং বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতীয় মঙ্গোলীয় ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠিগুলো নৃতাত্ত্বিক (মঙ্গোলীয়) স্বগোত্রীয় চীনাদের সহজেই বরণ করে নিতে পারে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর স্বার্থ: ব্রিটিশ আমলা রেজিনাল্ড কুপল্যান্ডের ‘কুপল্যান্ড প্ল্যান’-কে পুনরুজ্জীবন দান করে যদি পার্বত্য চট্টগ্রাম, ভারতের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাংশ ও মিয়ানমারের পার্শ্ববর্তী পার্বত্য এলাকা মিলে বা এর একাংশ নিয়ে একটা খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র গঠন করা যায়, তবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রভাব বলয় সৃষ্টি করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ পা রাখার জন্য একটি নতুন ঠাঁই পাবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদের সূত্রপাত, ইতিহাস ও বিদেশি হস্তক্ষেপ:

ব্রিটিশরা পার্বত্য চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর ঐ অঞ্চলে বাঙালি ও ভারতীয়দের প্রভাব খর্ব করার লক্ষ্যে ও সেখানে একটি স্থায়ী প্রশাসনিক ব্যবস্থা কায়েমের উদ্দেশ্যে ‘চিটাগাং হিল ট্রাক্টস রেগুলেশন, ১৯০০’ চালু করে, যা অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার প্রশাসক সেখানে সব ধরনের অভিগমন বা জনস্থানান্তর বন্ধ বা প্রতিরোধ করতে পারতেন। এর পেছনে ঔপনিবেশিক প্রশাসনের উদ্দেশ্য ছিল উপজাতি জনগোষ্ঠিগুলোকে একেক জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাসে বাধ্য করা। ১৯৩৫ সালে প্রণীত ভারত শাসন আইনে পার্বত্য চট্টগ্রামকে Totally Excluded Area বা ‘সম্পূর্ণ পৃথক অঞ্চল’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এর ফলে সমতল অঞ্চলের বাংলাভাষাভাষী জনগণের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের আর্থ-সামাজিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। মূলত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন এর মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চলে বাঙালিদের বসতি স্থাপন ও সেখানে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রকাশ রুখতে চাচ্ছিল। প্রায় জনশূন্য ও সম্পদসমৃদ্ধ পার্বত্য চট্টগ্রামের ওপর মিয়ানমার ও ভারতের উত্তর ও উত্তর-পূর্ব থেকে আগত বিভিন্ন উপজাতি জনগোষ্ঠির যদি অধিকার থেকে থাকে, তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংলগ্ন সমতলের বাংলাভাষী জনগণের অধিকার বেশি না হলেও সমান তো ছিলই। অন্যদিকে হাজার হাজার মাইল দূর থেকে আগত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের শাসন পাকাপোক্ত করার জন্য চিরাচরিত ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ পলিসি অনুসরণ করে তাদের শাসনামলে প্রণীত অযৌক্তিক আইনের ধারা দ্বারা এ অঞ্চলে ভবিষ্যৎ বিচ্ছিন্নতাবাদের বীজ বপন করে যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দাবির ভিত্তি মূলত ঔপনিবেশিক শাসনামলে প্রণীত এসব অযৌক্তিক আইনের ধারাসমূহই।

১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পরিপ্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অমুসলিম হওয়ার ভিত্তিতে ভারতীয় কংগ্রেস ভারতের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংযুক্তির দাবি করে বসে। কিন্তু মুসলিম লীগ পার্বত্য অঞ্চলের অহিন্দু জনগণের আধিক্য ও চট্টগ্রাম জেলার স্বার্থরক্ষার দাবিতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির দাবি জানায়। পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি প্রায় মেনে নেয়া হয়, কিন্তু শেষ মুহূর্তে শিখ সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাবের ফিরোজপুর জেলা ভারতের অন্তর্ভুক্তির বিনিময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেসময় পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি পার্বত্য অঞ্চলকে ভারতে সংযুক্তির জন্য দাবি জানায়, কিন্তু এ দাবির অসারতা উপলব্ধি করতে পেরে তারা The Hillman Association এর ব্যানারে পার্বত্য চট্টগ্রামকে দেশীয় রাজ্যের মর্যাদা প্রদানের দাবি জানায়। এ দাবি প্রত্যাখ্যাত হলে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে চাকমা নেতা স্নেহ কুমার চাকমা রাঙ্গামাটিতে ভারতের পতাকা উত্তোলন করেন এবং এর বিরোধিতা করে পার্বত্য অঞ্চলের দ্বিতীয় বৃহত্তম নৃ-গোষ্ঠি মারমা মগদের নেতৃবৃন্দ পালটা কর্মসূচী হিসেবে বান্দরবানে মিয়ানমারের পতাকা উত্তোলন করে। এ ঘটনা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠিদের মধ্যকার পারস্পরিক দ্বন্দ্বের প্রমাণ মেলে।

পাকিস্তান আমলে ১৯৫৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ মর্যাদা দিতে সরাসরি পাকিস্তানের ফেডারেল রাজধানী করাচী থেকে ঐ অঞ্চলের প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৬৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করা হয়। এর মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানান্তরের ওপর আইনী নিষেধাজ্ঞা তুলে ফেলা হয় এবং ব্যাপক হারে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি অভিবাসীদের আগমন ঘটতে থাকে। ১৯৬৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটিতে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ উদ্দেশ্যে কয়েকশ বর্গ কি.মি. জায়গা জুড়ে কাপ্তাই হৃদ নির্মাণ করা হয় এবং এ হ্রদের পানিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ৪০% চাষের ভূমি ডুবে যায়, বাড়ি হারায় হাজার হাজার চাকমা পরিবার। এদের অনেকেই পার্বত্য চট্টগ্রাম ছেড়ে ভারতে চলে যায়। পাকিস্তান সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের যে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করে তা ছিল অপ্রতুল। এ ব্যাপারটিও পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব বিকাশে ভূমিকা রাখে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদকে নবগঠিত রাষ্ট্রের সংবিধানের অন্যতম মৌলিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করে নেন। তিনি সকল উপজাতিকে বাঙ্গালী পরিচয় গ্রহণ করে নতুন রাষ্ট্রে অঙ্গীভূত হওয়ার আহবান জানান। এই আহবানের মধ্যে অবাঙালি উপজাতি জনগোষ্ঠি নিজেদের সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক স্বাতন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টা দেখতে পায়। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি চাকমা নেতা ও সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে একটি চাকমা প্রতিনিধিদল চারদফা দাবি উপস্থাপন করে। এগুলো হচ্ছে:

১। নিজস্ব কানুনসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন,
২। বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে বৃটিশ প্রণীত ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কিত ধারাগুলোর পুনঃ সংযোজন,
৩। প্রশাসনিক পূর্ণ ক্ষমতাসহ স্থানীয় উপজাতীয় রাজাদের ক্ষমতা প্রদান,
৪। সাংবিধানিকভাবে ১৯০০ সালের রেগুলেশনের অপরিবর্তনীয়তার নিশ্চয়তা বিধান এবং বাঙ্গালী পরিবারসমূহের স্থাপন বন্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসব দাবির মধ্যে ভবিষ্যৎ বিচ্ছিন্নতাবাদের বীজ লুকিয়ে থাকতে দেখে দাবিগুলো প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৭২ সালের ১৬ মে পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু চীনপন্থী কম্যুনিস্ট চাকমা উপজাতীয়দের অধিকারের দাবি-দাওয়াকে স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবিতে রূপান্তর করতে সচেষ্ট হয় এবং এ উদ্দেশ্যে জনসংহতি সমিতি নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারিতে জনসংহতি সমিতি থেকে জন্ম নেয় শান্তিবাহিনী। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর চোরাগোপ্তা হামলা ক্রমান্বয়ে গেরিলা হামলার রূপ নেয়। অশান্তি, হত্যা ও ধ্বংসের ভয়াবহতায় ছেয়ে যায় পার্বত্য অঞ্চল। ইতোমধ্যেই চাকমাদের দাবি দাওয়ায় আরো কিছু ধারা যোগ হয়, যেমন:

*১৯৪৭ সালের পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আগত সকল অ-উপজাতীয় অর্থাৎ বাংলাভাষী সকল জনসংখ্যাকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে পুরোপুরি উঠিয়ে নিতে হবে।
*পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সকল নিরাপত্তা বাহিনী উচ্ছেদ করে স্থানীয় উপজাতীয়দের দ্বারা গঠিত ও নিয়ন্ত্রিত নিরাপত্তা বাহিনী প্রতিষ্ঠিত করত হবে।
*পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসন, অর্থ-ব্যবস্থা ইত্যাদি সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ স্থানীয় উপজাতীয়দের উপর ন্যস্ত করতে হবে।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের বৃহত্তর স্বার্থের দিকে লক্ষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে সমতলের বিপুল সংখ্যক বাস্তুহারা, দরিদ্র ও ভূমিহীন বাঙালি চাষি পরিবারকে পুনর্বাসিত করেন। প্রেসিডেন্ট এরশাদও জিয়ার নীতি প্রায় একইরকমভাবে বহাল রাখেন। কিন্তু ভারতের সমর্থনে শান্তিবাহিনীর তৎপরতা বেড়েই চললে তা বাংলাদেশের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে প্রেসিডেন্ট এরশাদ শান্তিবাহিনীর সাথে আলোচনার পথে খুঁজতে থাকেন। এরশাদের পর বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারও শান্তি আলোচনা চালিয়ে যান। অবশেষে আওয়ামী লীগ শাসনামলে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের সাথে শান্তিবাহিনীর ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের পৃথক জাতিসত্তা এবং বিশেষ মর্যাদাকে স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং পার্বত্য অঞ্চলের তিনটি জেলার স্থানীয় সরকার পরিষদের সমন্বয়ে একটি আঞ্চলিক পরিষদ প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরিষদটি চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরাং এবং তঞ্চঙ্গ্যা উপজাতির পুরুষ ও মহিলাদের দ্বারা গঠিত হবে; প্রতিনিধিরা পার্বত্য অঞ্চলের জেলা পরিষদ দ্বারা নির্বাচিত হবেন। পাঁচ বছরের মেয়াদের জন্য নির্বাচিত কাউন্সিলের ওপর আইন-শৃঙ্খলা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং উপজাতীয় আইন বজায় রাখার, সাধারণ প্রশাসনের তত্ত্বাবধান, দুর্যোগ ত্রাণ ও ব্যবস্থাপনার সমন্বয়, ভারী শিল্পের জন্য লাইসেন্স প্রদান এবং অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পের তত্ত্বাবধানের কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারকে পার্বত্য অঞ্চল সংক্রান্ত সমস্ত বিষয়ে আঞ্চলিক পরিষদের সাথে পরামর্শ করতে হবে। চুক্তিতে পার্বত্য অঞ্চল সম্পর্কিত বিষয়গুলি পরিচালনার জন্য উপজাতীয় একজন ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি কেন্দ্রীয় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় স্থাপনেরও বিধান করা হয়েছে। চুক্তিতে বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের জমি ফেরত দেওয়ার পরিকল্পনা এবং পার্বত্য অঞ্চলে একটি বিস্তৃত ভূমি জরিপ চালানোর কথা রয়েছে। চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিকে বৈধতা দেয়া হয়। শান্তিবাহিনীর বিদ্রোহীরা আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের অস্ত্র সমর্পণ করে এবং আর্থিক ক্ষতিপূরণ পায়। এ চুক্তির ফলে পঞ্চাশ হাজারের বেশি বাস্তুচ্যুত নাগরিক তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে সক্ষম হয়েছিল। শান্তি চুক্তি সম্পাদনের এত বছর পর এসে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে শান্তিচুক্তির ধারাগুলো বাস্তবায়ন না করার অভিযোগ করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুরের মতে, শান্তি চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে, ১৫টি আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে এবং ৯টি ধারার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। অন্যদিকে জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমার অভিযোগ এই যে, শান্তিচুক্তির মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে, ১৩টির আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে এবং ৩৪টি এখনো অবাস্তবায়িত রয়ে গিয়েছে। সন্তু লারমার এসব অভিযোগকে প্রত্যাখ্যান করেছেন রাঙ্গামাটি সংসদীয় আসনের এমপি দীপঙ্কর তালুকদার। অন্যদিকে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় সন্তু লারমা বেশ কয়েকবার অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন এবং পুনরায় সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করার হুমকি দিয়ে রেখেছেন। তবে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর জনসংহতি সমিতির অস্ত্র সমর্পণের দিন তাদেরই একটি অংশ অস্ত্র জমা দিতে অস্বীকার করে জনসংহতি সমিতি থেকে আলাদা হয়ে যায়, যারা পরে ইউপিডিএফ গঠন করে এবং সশস্ত্র কার্যক্রম চালিয়ে যায়। এছাড়াও ধারণা করা হয় যে, জনসংহতি সমিতির অস্ত্রসমর্পণটি ছিল অনেকটা আইওয়াশের মতো। তারা তাদের উন্নত অস্ত্রশস্ত্রগুলো কখনো সমর্পণ করেনি, তাদের চৌকস যোদ্ধাদেরও আত্মসমপর্ণ করায়নি। ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভিতে ২০১১ সালে এক সাক্ষাৎকারে সন্তু লারমা স্বীকার করেছেন যে, শান্তিচুক্তির পর ২০০০ সালে জনসংহতি সমিতি অস্ত্র তুলে নেয়, যা শান্তিচুক্তির অন্যতম প্রধান একটি ধারার সুস্পষ্ট লংঘন। যদিও সন্তু লারমা এজন্য ইউপিডিএফকে প্রতিরোধের অযুহাত স্থাপন করেছেন। শান্তিচুক্তির পরও পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহীদের সশস্ত্র কার্যক্রম জারী রয়েছে। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিদ্রোহীদের বিভিন্ন হামলায় এখন পর্যন্ত ১৬ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য (৮ জন সেনা, বিজিবি ২ জন, পুলিশ ২ জন, আনসার ভিডিপি ২ জন), ৪৪১ জন উপজাতি, ২৭১ জন বাঙ্গালী নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৬৭২ জন উপজাতি এবং ৮২৮ জন বাঙালি। অপহৃত হয়েছে ৯৯১ জন উপজাতি ও ৪২০ জন বাঙালি। পাহাড়ে এখনো ১৩ হাজার উপজাতি বিদ্রোহী এখনো সক্রিয় আছে, যাদের ৩ হাজার সশস্ত্র এবং ১০ হাজার অর্ধসশস্ত্র।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদেশি হস্তক্ষেপ: ভারত মহাসাগর ও আশেপাশের অঞ্চলে প্রভাব বলয় সৃষ্টি করার নিমিত্তে ভারত, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউসহ অনেক আন্তর্জাতিক গোষ্ঠিই পার্বত্য চট্টগ্রামের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলিয়ে আসছে। জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মতো রাষ্ট্রেরও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার নজির আছে। সাম্প্রতিক বিশ্বের ‘বিশ্ব মঙ্গোলীয়’ বা ‘বিশ্ব বৌদ্ধ পুনরুত্থান’-এর প্রেক্ষাপটে ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব সৃষ্টি করার প্রচেষ্টার একটি অংশ হিসেবে জাপান দ্বারা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্রোহীদের আর্থিক সাহায্য প্রদানের খবর পাওয়া গিয়েছে। তবে বিদেশি হস্তক্ষেপকারী শক্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে তৎপর হিসেবে পাওয়া গিয়েছে ভারতকে। চাকমা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ত্রিপুরায় আশ্রয় দেয়া, তাদের সংগঠিত করা, প্রশিক্ষণ দেয়া, অস্ত্র সরবরাহ করা এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে সমর্থন দেয়ার পিছেন ভারতের শক্ত ভূমিকার কথা জানা যায়। স্বয়ং শান্তিবাহিনীর এক মুখপাত্রের স্বীকৃতি অনুযায়ীই এর সত্যতা মেলে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পেছনে চীনের সমর্থনের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। পার্বত্য চট্টগ্রাম, ভারতের উত্তর-পূর্বাংশ এবং মিয়ানমারের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাংশের মঙ্গোলীয় নৃ-গোষ্ঠির জনগণের মধ্যে বৃহত্তর কনফেডারেটরি রাষ্ট্র গঠনের আকাক্সক্ষা দেখা যায়। এসব অঞ্চলের বিদ্রোহীদের অনেকেই মাওপন্থী কম্যুনিস্ট। চীন যদি এই অঞ্চলে নিজের প্রভাব বলয় সৃষ্টি করার জন্য এসব গেরিলা গ্রুপগুলোকে একত্রিত ও সংবদ্ধ করে তাদের সাহায্য করে তবে অবাক হওয়ার তেমন কিছু নাই। তবে বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক (যাদের অধিকাংশই পশ্চিমা) এনজিও, দাতব্য সংস্থা ও খ্রিস্টান মিশনারীদের কার্যক্রম আশঙ্কাজনক রূপ নিয়েছে। এর জন্য জানতে হবে উপমহাদেশ বিভাগকালীন কিছু ইতিহাস। ব্রিটিশরা ভারত উপমহাদেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে ব্রিটিশরা পার্বত্য চট্টগ্রাম, ভারতের উত্তর-পূর্বাংশের পার্বত্য এলাকা ও পার্শ্ববর্তী মিয়ানমারের পার্বত্য এলাকা নিয়ে একটি ‘ক্রাউন কলোনি’ গঠনের কথা ভাবছিল, যা উপমহাদেশের স্বাধীনতা আলোচনার বাইরে থাকবে এবং সরাসরি ব্রিটিশদের দ্বারা শাসিত হবে। এ প্রস্তাবের পরিকল্পনাকারী ছিলেন ব্রিটিশ আমলা রেজিনাল্ড কুপল্যান্ড। এই পরিকল্পনা প্রায় বাস্তবায়িত হতে হতে ভেস্তে গিয়েছিল। কিন্তু এত বছর পর এসে এই পরিকল্পনা যদি গোপনে পুনরুজ্জীবিতও করা হয়, তবে অবাক হওয়ার কিছু নেই। উক্ত অঞ্চলে যদি একটা খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ বাফার স্টেইট গঠন করা যায়, তাহলে ভারত ও চীনের মতো সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ পরাশক্তিগুলোর বাধা পেরিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আমেরিকা ও ইইউ আরো সহজে প্রবেশাধিকার পাবে এবং পুরো দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপর আরো শক্ত নজরদারী করতে পারবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে কয়েকশ এনজিও ও খ্রিস্টান মিশনারী সংগঠন সক্রিয় রয়েছে, যারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে খ্রিস্টানকরণের পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের ৩০%, মারমাদের ৫০% এবং ত্রিপুরাদের ৭০% ইতোমধ্যেই খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে গিয়েছে। পাঙ্খো, লুসাই, মুরং, চাক-এর মতো কিছু কিছু ক্ষুদ্র উপজাতি গোষ্ঠির প্রায় ১০০% সদস্য এখন খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত। এসব এনজিও ও মিশনারীদের অনেকেই বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণায় লিপ্ত।

আদিবাসী-উপজাতি বিতর্ক: জনসংহতি সমিতি ও সন্তু লারমা ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করার সময় নিজেদের উপজাতি স্বীকৃতি মেনে নিয়েছিলেন। শান্তিচুক্তির ৭২টি ধারার কমপক্ষে ৫০টি ধারায় উপজাতি শব্দটির উল্লেখ আছে, যেগুলো মেনে নিয়েই সন্তু লারমা এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের অবাঙালিরা নিজেদের আদিবাসী হিসেবে পরিচয় দেয়া শুরু করে। বর্তমানে তাই পার্বত্য চট্টগ্রামে অবাঙালি জনগোষ্ঠিকে আদিবাসী বলা হবে নাকি উপজাতি সে নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে।

প্রথমত দেখা যাক, নৃতাত্ত্বিকভাবে পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিগুলোকে আদিবাসী বলা যায় কিনা। বিখ্যাত নৃতাত্ত্বিক খবরিং Lewis Henry Morgan বলেন, The Aboriginals are the groups of human race who have been residing in a place from time immemorial… They are the true sons of the soil. অর্থাৎ ‘আদিবাসীরা হচ্ছে সেসব গোষ্ঠি, যারা কোনো স্থানে স্মরণাতীত অতীত থেকে বসবাস করে আসছে, তারাই সেই মাটির প্রকৃত সন্তান।’ সকল ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশের পাহাড়ি উপজাতি জনগোষ্ঠির কেউই বাংলাদেশে স্মরণাতীত কাল থেকে বসবাস করছে না। তাদের সকলেই ৫-৭ শতক আগে বাইরে থেকে, বিশেষ করে, ভারত ও মিয়ানমার থেকে এ দেশে প্রবেশ করেছে। প্রখ্যাত বৃটিশ নৃতাত্ত্বিক ও ঔপনিবেশিক প্রশাসক T.H. Lewin. খবরিহ বলেন, A greater portion of the hill tribes, at present living in the Chittagong Hills, undoubtedly came about two generations ago from Arracan. This is asserted both by their own traditions and by records in the Chittagong Collectorate. অর্থাৎ, ‘কোনো সন্দেহ নেই যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করা বর্তমান পাহাড়ি জনগোষ্ঠিগুলোর বেশিরভাগই দুই প্রজন্ম পূর্বে আরাকান থেকে এসেছে। এসব জনগোষ্ঠির নিজস্ব ঐতিহ্য ও চিটাগাং কালেক্টরেটেই এর উল্লেখ রয়েছে।’ উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পাহাড়ের সবচেয়ে বড় উপজাতি গোষ্ঠি চাকমাদের ইতিহাস সম্পর্কে দুটি তত্ত্ব পাওয়া যায়। উভয়টির মতেই, চাকমারা বাইরে থেকে এসে পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের বর্তমান আবাসভূমিতে বসতি স্থাপন করে। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তাত্ত্বিক অভিমত অনুযায়ী, চাকমারা মূলত ছিল মধ্য মায়ানমার ও আরাকান এলাকার অধিবাসী। এ ছাড়াও তারা চট্টগ্রাম ও আরাকানের পাহাড়ি অঞ্চলে এককালে বসবাসকারী সাক (চাক, ঠেক) নামে এক জনগোষ্ঠির সঙ্গেও সম্পর্কিত ছিল। অপর তাত্ত্বিক অভিমতটির সমর্থনে কোনো ঐতিহাসিক সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় না। এ অভিমতে বলা হয়, চাকমারা উত্তর ভারতের চম্পকনগর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে অভিবাসী হিসেবে আসে। পার্বত্য চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহত্তম উপজাতি গোষ্ঠি মারমা জনগণের আদিনিবাস ছিল বার্মার পেগু নগর। আরাকান রাজার সেনাধিনায়ক মহাপিন্নাগি ১৫৯৯ সালে বার্মায় আক্রমণ চালান। তখন মারমারা বঙ্গীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। তৃতীয় বৃহত্তম উপজাতি নৃ-গোষ্ঠি ত্রিপুরাদের জনগোষ্ঠির ইতিহাস থেকে জানা যায়, আনুমানিক ৬৫ খ্রিস্টাব্দে সুই বংশের সময়কালে পশ্চিম চীনের ইয়াংসি ও হোয়াংহো নদীর উপত্যাকায় ছিল এদের আদিনিবাস। পরবর্তীতে এই জনগোষ্ঠি ভারতের আসামের মধ্য দিয়ে এসে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পার্বত্য এলাকায় বসতি গড়ে তোলে এবং রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীতে এরা নিজ এলাকা ছেড়ে বাংলাদেশের মূলত কুমিল্লা, সিলেট এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় বসতি স্থাপন করে। মজার ব্যাপার হলো, যে ভারত ও মিয়ানমার থেকে তাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে আগমন, সেই ভারত ও মিয়ানমারও তাদের দেশে অবস্থিত এসব উপজাতি গোষ্ঠিকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব আলামত পাওয়া গিয়েছে সেগুলোর ঐতিহাসিক অস্তিত্বকাল খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০-৫০০ এর মধ্যে। এসব বিষয়কে বিবেচনায় রাখলে কোনভাবেই পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি জনগোষ্ঠিকে নৃতাত্ত্বিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের আদিবাসী হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না।

এজন্যই যারা পাহাড়ি উপজাতি জনগোষ্ঠিকে আদিবাসী হিসেবে আখ্যায়িত করার পক্ষে, তাদের International Labour Organization বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থা (ILO)’র কনভেনশন-১৬৯ এ দেয়া আদিবাসীর সংজ্ঞার দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। এই কনভেনশনের আর্টিকেল ১ (ধ)-তে উপজাতি ও ১ (ন)-তে আদিবাসী উভয়টির সংজ্ঞা পৃথকভাবে দেয়া হয়েছে। আর্টিকেল ১ (ধ)-তে বলা হয়েছে:

(This convention applies to) tribal peoples in independent countries whose social, cultural and economic conditions distinguish them from other sections of the national community, and whose status is regulated wholly or partially by their own customs or traditions or by special laws or regulations;

অর্থাৎ ‘(এই কনভেনশনটি প্রযোজ্য হবে) একটি স্বাধীন দেশের উপজাতিদের জন্য, যারা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দেশের অন্যান্য সম্প্রদায় থেকে ভিন্নতর এবং পুরোপুরি বা আংশিকভাবে তাদের নিজস্ব আচার বা ঐতিহ্য অথবা বিশেষ আইন দ্বারা পরিচালিত।’ এই সংজ্ঞাটি সুস্পষ্টভাবে পাহাড়ি চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন অবাঙালি নৃ-গোষ্ঠিকে উপজাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু উপজাতিদের আদিবাসী হিসেবে আখ্যায়িত করার সমর্থকগণ আর্টিকেল ১ (ন) থেকে indigenous তথা আদিবাসী জনগোষ্ঠির সংজ্ঞা হাজির করেন। আর্টিকেল ১ (ন)-তে আছে:

(This convention applies to) peoples in independent countries who are regarded as indigenous on account of their descent from the populations which inhabited the country, or a geographical region to which the country belongs, at the time of conquest or colonisation or the establishment of present state boundaries and who, irrespective of their legal status, retain some or all of their own social, economic, cultural and political institutions.

অর্থাৎ ‘(এই কনভেনশন প্রযোজ্য হবে) একটি স্বাধীন দেশের সেসব মানুষদের জন্য, যাদের পূর্বপুরুষরা সেই দেশ বা যে অঞ্চলে দেশটি অবস্থিত সে অঞ্চল সামরিকভাবে বিজিত অথবা উপনিবেশকরণ অথবা বর্তমান রাষ্ট্র সীমানা প্রতিষ্ঠা করার সময়েই বংশ পরম্পরায় বসবাস করে আসছে এবং আইনগত অবস্থা নির্বিশেষে তারা তাদের কিছু বা সকল সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বজায় রেখেছে।’ কথা হচ্ছে, এ সংজ্ঞা অনুসারে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠিগুলোকে কি আদিবাসী বলা যায়? অর্থাৎ তারা কি বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ড সামরিকভাবে বিজিত কিংবা এই জায়গায় উপনিবেশ স্থাপনের আগে থেকেই বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ছিল কিনা? এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রথম উপনিবেশ স্থাপনকারী ছিল আর্যরা, যারা উত্তর বঙ্গ দিয়ে বর্তমান বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তখন বাংলাদেশ ভূখণ্ডে কোন পার্বত্য নৃ-গোষ্ঠির উপস্থিতি ছিল না। আর্যদের আসার আগে এই ভূখণ্ডে অনার্যদের বসবাস ছিল যারা ছিল নৃতাত্ত্বিকভাবে দ্রাবিড়, তিব্বত-বর্মী এবং অস্ট্রো-এশীয় এবং প্রাকৃত ধর্মের অনুসারী। পরবর্তীতে এ ভূখণ্ডে আরো বিভিন্ন জাতির আগমন ও তাদের সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে বাঙালি নামে পৃথক একটি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠির উৎপত্তি হয়েছে। তাই বলা যায়, বাঙালিরাই বাংলাদেশের আদিবাসী। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের অবাঙালি নৃ-গোষ্ঠির লোকেরা নৃ-তাত্ত্বিক দিক দিয়ে মঙ্গোলয়েড, যারা অতীতের ৫-৭ শতক আগে বিভিন্ন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি গেঁড়েছে। তাদের বাংলাদেশের আদিবাসী এজন্যই বলা যায় না যে, বাঙালিরা তাদের তাড়িয়ে বাংলাদেশ দখল করেনি বা তাতে উপনিবেশ গাঁড়েনি। এটা ঠিক যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের চেয়ে এসব পার্বত্য নৃ-গোষ্ঠির ইতিহাস পুরনো। কিন্তু তাই বলে আঞ্চলিকতা বিবেচনায় যদি এসব নৃ-গোষ্ঠিকে পাহাড়ি আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় তাহলে অসঙ্গতি দেখা দেবে। তখন বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলেই নতুন নতুন ‘আঞ্চলিক আদিবাসী’ স্বীকৃতির দাবি উঠবে। উদাহরণস্বরূপ, সেন্টমার্টিন দ্বীপে যারা প্রথম বসতি গেড়েছে তারা অথবা পুরান ঢাকার আদি বাসিন্দারাও আদিবাসী স্বীকৃতির জন্য দাবি করতে পারে। এজন্যই বলা যায়, একটি দেশের মধ্যে কোন আঞ্চলিক আদিবাসী থাকতে পারে না। আদিবাসী হয় পুরো দেশের। সে অর্থে উত্তর আমেরিকায় রেড ইন্ডিয়ান গোত্রসমূহ, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে অস্ট্রেলিয়ার মূলভূমি, টরেস স্ট্রেইট আইল্যান্ডার, মাউরির মতো জনগোষ্ঠিগুলোকে আদিবাসী বলা চলে। এছাড়াও, বাংলাদেশ যদি দেশের মধ্যকার কোনো জনগোষ্ঠিকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার কনভেনশন ১৬৯ ও ২০০৭ সালে প্রণীত জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণা মেনে নিতে হবে, পারতপক্ষে যেটার অনুচ্ছেদ ৩, ৪, ৫, ১৯, ২৬.৩, ২৭, ৩০.১, ৩২.২ এবং ৩৬.১ মানতে গেলে বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে আদিবাসীদের স্বশাসিত অঞ্চলের উদ্ভব হবে এবং সেসব জায়গায় কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ একেবারেই লঘু হয়ে যাবে। এর ফলে বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হবে। ফলে অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও যৌক্তিক কারণে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা প্রণীত কনভেনশন ১৬৯-এ স্বাক্ষর করেনি এবং এ দেশে কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠিকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সার্বভৌমত্ব রক্ষায় করণীয়: পার্বত্য চট্টগ্রাম সমগ্র বাংলাদেশের এক-দশমাংশ এবং বাংলাদেশের জন্য ভূরাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের সাথে একীভূত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপই নিতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের করণীয়গুলোকে সরকার ও জাতির করণীয়তে ভাগ করা যেতে পারে।

সরকারের করণীয়: সরকারকে অবশ্যই পার্বত্য পাহাড়ি উপজাতিদের বিরুদ্ধে সকল রকমের বৈষম্য দূর করার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। পাহাড়ে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদকে স্রেফ ‘সামাজিক অসন্তোষ’-এর ফল হিসেবে আখ্যায়িত করা হবে এক ধরনের পলায়নবাদী নীতি। পাহাড়ি উপজাতিদের অযৌক্তিক অভিযোগ ও দাবিগুলো থেকে যৌক্তিক অভিযোগ ও দাবিগুলোকে আলাদা করে সেগুলোর ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ৬ (২) অনুচ্ছেদে নাগরিকত্বের ব্যাপারে বলা হয়েছে: ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙ্গালী এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন।’ ২৩(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠি ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ যদিও সংবিধানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিগুলোর স্বাতন্ত্র্য বজায় ও তা বিকাশের ব্যাপারে রাষ্ট্রের দায়িত্বকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে, কিন্তু এরপরও বাংলাদেশের সকল নাগরিকদের জাতি হিসেবে বাঙালি হিসেবে আখ্যায়িত করার মাধ্যমে অবাঙালি পাহাড়িদের ওপর বাঙালি নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয় একরকম চাপিয়ে দেয়া হয়েছে এবং অবাঙালি উপজাতি এতে মনস্তাত্ত্বিকভাবেই নিজেদের বিচ্ছিন্ন মনে করবে। নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের সকল নাগরিক বাংলাদেশি হিসেবে পরিচিত হবে, এতটুকুই যথেষ্ট ছিল, পৃথকভাবে সকল জনগণের জন্য জাতি হিসেবে বাঙালি পরিচয় প্রয়োজন ছিল না। সংবিধানের উক্ত অনুচ্ছেদ সংশোধন করে তা থেকে জাতি পরিচয়ের উপরোল্লিখিত ধারাটি বাদ দেয়া যেতে পারে। যদিও, পার্বত্য অঞ্চলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আগের থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। উন্নয়নের গতি আরো বৃদ্ধি করে পার্বত্য জনগোষ্ঠিকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের জনগণের সমকাতারে নিয়ে আসতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন উপজাতি যেন নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ব্যাপারে জ্ঞান লাভ করতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিগুলোকে তাদের নিজস্ব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বজায় রাখার সুযোগ দিতে হবে। পাহাড়ে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে। পার্বত্য বিদ্রোহীরা শান্তিচুক্তি অনুযায়ী পুরোপুরিভাবে আত্মসমর্পণ না করা পর্যন্ত সেখানে সামরিক প্রতিরক্ষা শিথিল করার সুযোগ নেই।

জাতির করণীয়: এবার আসা যাক, জাতি বা নাগরিক হিসেবে আমাদের করণীয়ের ব্যাপারে। প্রথমত, পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যে চক্রান্ত চলছে সে ব্যাপারে আমাদের সচেতনতা ও যথাযথ জ্ঞান লাভ করতে হবে। পার্বত্য সংঘাত নিরসনে সরকার যাতে যথাযথ পদক্ষেপ নেয় এবং তাতে কোনো প্রকার শিথিলতা প্রদর্শন না করে সেজন্য সরকারকে চাপে রাখতে হবে। সমতল ও পার্বত্য অঞ্চলে যেসব বাঙালি অধিবাসী আছে, তাদের উচিত উপজাতি জনগণের সাথে প্রতিবেশী ও স্বদেশবাসী হিসেবে সদাচরণ করা এবং তাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যকে সম্মান করা। উপজাতিরাও যে একই মাত্রায় বাংলাদেশের নাগরিক এবং বাংলাদেশের ওপর তাদেরও যে সমান অধিকার রয়েছে সেই মনোভাব সামাজিক সদাচরণের মাধ্যমে উপজাতি জনগোষ্ঠির অন্তরে জাগ্রত করা উচিত, যাতে তারা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এ দেশে একাঙ্গীভূত অনুভব করে।

ড. মো. আবদুর রব: সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল এবং পরিবেশ ডিপার্টমেন্ট
কাজী শিহান মির্জা: কলামিস্ট

তথ্যসূত্র:- পার্বত্য নিউজ