রাঙামাটি । শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ , ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ-

প্রকাশিত: ১৬:৩৪, ২ ডিসেম্বর ২০২২

​​​​​​​পাহাড়ে থামেনি ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত, নতুন করে জন্ম নিয়েছে কেএনএফ নামক সশস্ত্র গোষ্ঠী

পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২৫ বছর পূর্তি আজ

পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২৫ বছর পূর্তি আজ

আজ ২ ডিসেম্বর। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ২৫তম বর্ষপূর্তি। পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫তম বর্ষপূর্তির পরও পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি এখনো। হানাহানি আর ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে পার্বত্য অঞ্চল এখনো অশান্ত। সরকারের পক্ষ থেকে অধিকাংশ শর্ত পূরণ করা হলেও পার্বত্য আঞ্চলিক সংগঠনগুলো বা পাহাড়ী নেতারা তাদের শর্তগুলো পূরণ হয়নি বলে মতব্যক্ত করছেন। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করা না করা নিয়ে পাহাড়ীদের মাঝে যেমন রয়েছে হতাশা, তেমনি পাহাড়ে বসবাসকারী বাঙ্গালীদের মাাঝে চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে রয়েছে প্রবল বিরোধীতা।

আর প্রধান শর্ত হিসেবে সশস্ত্র পার্বত্য আঞ্চলিক সংগঠনগুলো তাদের অবৈধ অস্ত্রই এখনও জমা দেয়নি বরং তাদের বহরে ধীরে ধীরে যুক্ত হয়েছে এসএমজি, এলএমজি, রাইফেল, স্নাইপার রাইফেলসহ অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র। আর এইসব মারণাস্ত্র ব্যবহার করে তারা পুরো পার্বত্য এলাকায় একের পর এক হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এতে করে এলাকায় শান্তির পরিবর্তে অশান্তি সৃষ্টি করে চলেছে সন্ত্রাসীরা। এখনো গোলাগুলির শব্দে গভীর রাতে ঘুম ভাঙ্গে পার্বত্য এলাকায় বসবাসরত সাধারণ মানুষের। সশস্ত্র সংঘর্ষে পড়ছে লাশের পর লাশ।

অব্যাহত রয়েছে আদিপত্য বিস্তারের লড়াই। থেমে নেই পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল (সন্তু লামার (গ্রুপ) পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, (মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা গ্রুপ) পার্বত্য জনসংহতি সমিতি সংস্কারপন্থী ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নামের সংগঠনগুলো সশস্ত্র কর্মকান্ড।

এছাড়া পাহাড়ে নতুন করে জন্ম নিয়েছে ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ (কেএনএফ) নামে সশস্ত্র গোষ্ঠী। তারা বান্দরবান ও রাঙামাটির বিলাইছড়ি সীমান্তঘেঁষা দূর্গম পাহাড়ে  ঢাকা, কুমিল্লা ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জঙ্গিবাদের জড়িয়ে নিরুদ্দেশ হওয়া কিছু তরুনদের জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। এমন সংবাদের ভিত্তিতে গত অক্টোবর এইসব দুর্গম এলাকায় সেনাবাহিনী ও র‌্যাবের সন্ত্রাস বিরোধী চিরুনি অভিযান চালিয়ে জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র ৭জন এবং পাহাড়ি বিছিন্নতাবাদী সংগঠনের ৩জনসহ মোট ১০ জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এ সময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। বর্তমানেও চলমান রয়েছে বান্দরবানের রুমা ও রোয়াংছড়িতে যৌথবাহিনীর অভিযান।

এছাড়া পার্বত্য পার্বত্য অঞ্চলে চারটি সংগঠনের পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া চাঁদাবাজি এবং বাঙালি-পাহাড়ীদের ভূমি জটিলতাও প্রকট আকার ধারণ করেছে। এমন এক অবস্থার কারণে পাহাড়ে এখনও ফিরেনি শান্তির পরিবেশ। এখনও ভাতৃঘাতি সংঘাটে পাহাড়ে ঝরছে রক্ত। থামেনি অভ্যন্তরীণ হানাহানি। এ কারণে শান্তি চুক্তির এই ২৫ বছরে এসে ওই শান্তি চুক্তির কিছু ধারা পরিবর্তন বা ‘রিভিউ’ করার জোরালো দাবি তুলেছেন পার্বত্য অঞ্চলের সাধারণ বাঙালি নেতারা। কোনো কোনো মহল এই চুক্তির বিপক্ষে যেমন নেতিবাচক সমালোচনা করেছে অন্যদিকে বিভিন্ন দেশীয় আর্ন্তজাতিক মহল কর্তৃক ব্যাপক ভাবে প্রশংসিতও হয়েছে।

উল্লেখ্য, দেশের এক-দশমাংশ পার্বত্য অঞ্চলের রক্ষক্ষয়ী লড়াই বা হানাহানি বন্ধ করে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার উপজাতি সশস্ত্র সংগঠন জেএসএসের সঙ্গে ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তি করেছিলেন। আজ বৃহস্পতিবার (২ ডিসেম্বর) সেই পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২৫ বছর পূর্ণ হলো। এরপর সরকার চুক্তির পরে দুর্গম পার্বত্য চট্টগ্রামের অঞ্চলে রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিসহ সব ক্ষেত্রেই ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। ওই শান্তি চুক্তির ফলে সাময়িক ভাবে বন্ধ হয় দীর্ঘদিন ধরে চলা সশস্ত্র সংঘাত। কিন্তু সেটি বেশিদিন স্বায়ী হয়নি। বরং শান্তি চুক্তির বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে পাহাড়িদের একটি পক্ষ। যার অন্যতম হচ্ছে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। যদিও বিভিন্ন সময়ে সংবাদ সম্মেলনে পার্বত্য শান্তি প্রতিষ্ঠা না হওয়ার জন্য সরকারকেই দোষারোপ করেন প্রতিমন্ত্রীর সুযোগ-সুবিধা ভোগকারী সন্তু লারমা।

উল্লেখ্য, ১৯৯৭ সালে সরকারের সঙ্গে সন্তু লারমার শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ছেড়ে ইউপিডিএফ গঠন করেন প্রসীত খিসা। এরপর ইউপিডিএফ ভেঙ্গে হয় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও জেএসএস (সংস্কার)। নতুন নতুন দল ও বাহিনী গঠিত হয়ে জড়িয়ে পড়েছে চাঁদাবাজি, হত্যা, ধর্ষণ ও অপহরণের মতো অপকর্মে। এই সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধ এবং আধিপত্যের কারণে বেড়েছে রক্ষক্ষয়ী লড়াই ও সংঘাত। অভিযোগ রয়েছে, বেপরোয়াভাবে ওইসব অপকর্ম ঘটালেও কঠোর ভাবে তাদের দমন করা হচ্ছে না। উল্টো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সুযোগ নিয়ে সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীসহ পার্বত্য অঞ্চলের নিরীহ বাঙালিদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার ও পোপাগান্ডা চালাচ্ছে তারা।

সরকার কর্তৃক ক্রমান্বয়ে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের বিভিন্ন পদক্ষে গ্রহণ করা সত্বেও পার্বত্য আঞ্চলিক দলগুলো সরকারকে সহযোগিতা না করে চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতা নেই মর্মে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া জেএসএস ও ইউপিডিএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা প্রতিনিয়ত সংর্ঘষ, অপহরণ, গুম, হত্যা, চাঁদাবাজি ইত্যাদি নানাবিধ অপরাধমূলক সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়ে পাহাড়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করছে। তাদের এই অপকর্মের শিকার হচ্ছে এখানকার সাধারণ মানুষ। আর আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর এইসব অপতৎপরতামূলক কার্যক্রমের কারণে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নকে যেমন ব্যাহত করছে তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান শান্তিও বিনষ্ট করছে। এই প্রেক্ষাপটে পাহাড়ে শান্তি রক্ষায় এবং শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের স্বার্থে পাহাড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখা, অবৈধ অস্ত্রধারীদের রিরুদ্ধে জোরালো অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন এবং একই সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর মধ্যে পরস্পর ভ্রাতৃত্ববোধ, সহযোগিতা, সহবস্থানের মনোভাব ও সাম্প্রদায়িক বৈরিতা-বৈষম্য ভুলে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে সম্মিলিত ভাবে কাজ করতে হবে বলে মনে করছে অভিজ্ঞ মহল।

জনপ্রিয়