রাঙামাটি । বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ , ১৩ চৈত্র ১৪৩০

নিউজ ডেস্কঃ-

প্রকাশিত: ১২:২৩, ৮ এপ্রিল ২০২০

আলো অপেক্ষা করছে ওপারে

আলো অপেক্ষা করছে ওপারে

করোনাভাইরাস পৃথিবীজুড়ে মহামারী রূপেই দেখা দিয়েছে। মহামারীর প্রচণ্ডতা ইউরোপ-আমেরিকা যেভাবে দেখছে, আমরা হয়তো তেমন ভয়ংকর রূপ এখনও দেখিনি। তবে ভবিতব্য জানি না। অবশ্য কামনা করব, আমাদের দেশে ধীরে ধীরে ভাইরাস শক্তি হারিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়বে। ঐশ্বরিক ইচ্ছায় তেমনটি হবে কিনা জানি না, হলে এর চেয়ে উত্তম আর কিছু হতে পারে না। তবে বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিতে বলব, করোনাযুদ্ধে জয়ী হওয়ার সূত্র আমাদের হাতেই রয়েছে। এখন প্রয়োজন যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল আচরণ করা। রাজনৈতিক ঝগড়া ভুলে পারস্পরিক দোষ না খুঁজে আত্মপ্রচারে মগ্ন না থেকে আন্তরিকতার সঙ্গে নির্ধারিত দায়িত্ব যদি পালন করতে পারি তাহলে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা অনেকটাই কমে যাবে। একইসঙ্গে বিশেষজ্ঞদের বিধানমতো যদি সতর্কতার সঙ্গে আমরা চলতে পারি, তবে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারব ভাইরাসের আক্রমণ। হাজার বছর ধরে লড়াই করে নিজের অবস্থান তৈরি করেছে বাঙালি। লড়াই করেছে স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য। লড়াই করেছে দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে। লড়াই করেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে। এবারও লড়াই করছে লড়াকু বাঙালি। নিশ্চয়ই এ সাময়িক অন্ধকার কেটে যাবে। আলো অপেক্ষা করছে ওপারে।

এর মধ্যে ছোটখাটো নানা ঘটনা ও অঘটন ঘটছে। ফেসবুক সংস্কৃতির যুগে অনেক ঘটনা বিশাল গুরুত্ব দিয়ে ভাইরাল করা হচ্ছে। গুজবও ছড়াচ্ছে কম না। প্রমাণ ছাড়া বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যকে তাচ্ছিল্য করা এবং শীলতাহীন বাক্যালাপ করার মতো বিশেষজ্ঞেরও অভাব হচ্ছে না ফেসবুকে। এসবে দিনের পর দিন মনোযোগ ধরে না রেখে যদি করোনা-মুক্তির জন্য লড়াইয়ে বেশি মনোযোগ দেই, তবে বিশেষ উপকার হয়। এর জন্য প্রয়োজন সবার দায়িত্বশীল আচরণ করা। কুড়িগ্রামের ডিসি ও ম্যাজিস্ট্রেটদের সাংবাদিক নিগ্রহ নিঃসন্দেহে এখতিয়ারবহির্ভূত গর্হিত কাজ। এ নিয়ে অনেক প্রতিবাদ হয়েছে। তাৎক্ষণিক ভূমিকা রেখেছে প্রশাসন ও আদালত। বিভাগীয় মামলা হয়েছে। আপন গতিতে সে মামলা চলুক। এখন আর এসব চর্চা না করে আমরা করোনা নিয়েই মনোসংযোগ করি। যশোরের মনিরামপুরের তরুণী ম্যাজিস্ট্রেট নিন্দাযোগ্য কাজ করেছেন বয়সী নাগরিককে হেনস্তা করে। এ নিয়ে হৈচৈ অনেক হয়েছে। বিভাগীয় ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। এখন এর তাপ-উত্তাপ বাড়ানোর কোনো কারণ নেই।

পাশাপাশি ভিন্ন চিত্রও আমরা দেখতে পেয়েছি। অনেক জেলা প্রশাসক, ইউএনও, ম্যাজিস্ট্রেটসহ সরকারি কর্মকর্তারা আন্তরিকতার সঙ্গে দুস্থের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তাররা জীবনবাজি রেখে রোগীর সেবা করে যাচ্ছেন। আমরা মনে করি, করোনাযুদ্ধে জয়ী হতে মানুষের মনোবল চাঙা রাখতে হবে। সরকার কী ভূমিকা রাখল আর কতটা রাখতে পারল না অথবা স্বাস্থ্য বিভাগ বা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বহীনতা কতটা, এসব নিয়ে তর্ক করার সময় নয় এখন। মহামারী উচ্চ-নিম্ন ভেদ করে না। রাজা-মন্ত্রী আর সাধারণ মানুষ দেখে বিষ ছড়ায় না। সুতরাং, সরকার বা প্রশাসনের সাধ্যমতো চেষ্টা করা উচিত এবং বাস্তব পর্যবেক্ষণ মতে সে ভূমিকা তারা রাখছেনও।

এ সময়ে হঠকারী সিদ্ধান্ত আমাদের হতাশ করছে। যেখানে মানুষকে ঘরে আটকে রাখতে সেনাবাহিনী পর্যন্ত নামানো হয়েছে, যেখানে সরকারের চেয়ে বড় শক্তিধর বিজিএমইএ ও বিকেএমই কারখানা খুলে দিচ্ছে কেমন করে! বাণিজ্যমন্ত্রীও সায় দিচ্ছেন। তাহলে করোনাভাইরাস সংকট প্রতিহতের জন্য গঠিত জাতীয় কমিটির কাজ কী! দরিদ্র পোশাক শ্রমিকদের সামনে বেতনের মুলা ঝুলিয়ে টেনে আনা হল শহরে। এখন আবার চাপে পড়ে অবস্থাভেদে বলা হচ্ছে ৭ থেকে ১১ তারিখ পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। শারীরিক-মানসিক কষ্টের কথা বাদ দিলাম; এসব কারণে শ্রমিকদের আর্থিক ক্ষতির দায় কি ফ্যাক্টরিগুলো নেবে?

পাশাপাশি মানতে হবে, কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা আমরা সাধারণ মানুষ অনেকেই তেমনভাবে রাখছি না। এমন মহামারীর অভিজ্ঞতা শুধু আমাদের কেন, সারা দুনিয়ারই ছিল না। তাবৎ শক্তিমান দেশগুলো মৃত্যুপুরীর ভেতর অসহায় হয়ে পড়েছে। কতটা অসহায় যে যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিমান দেশ; আমাদের মতো দেশের কাছেও সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়েছে। এমন মহামারী মোকাবেলা জন্য প্রস্তুত তো কেউ ছিল না। তাই উন্নত দেশগুলোর হাসপাতালেও স্বাস্থ্য পরীক্ষার চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব প্রকট। তবুও ভালো, প্রাথমিক ধাক্কা সামলিয়ে সরকার, স্বাস্থ্য বিভাগ চিকিৎসা সরঞ্জাম অনেক বেশি সংগ্রহ করে যাচ্ছে, পিপিই উৎপাদন করছে, মাস্ক বানাচ্ছে; দেশীয় অনেক প্রতিষ্ঠান হ্যান্ড স্যানিটাইজার উৎপাদন করছে। দেশীয় বিজ্ঞানীরা ভেন্টিলেটর তৈরি করার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।

আসলে সংকট যা তৈরি করছি, তা বাণিজ্যবুদ্ধিসম্পন্ন হঠকারী ক্ষমতাবানরা; আর আমরা সাধারণ মানুষ। বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী যেহেতু এ ভাইরাস প্রতিহত করার মতো কার্যকর প্রতিষেধক তৈরি হয়নি, তাই সুরক্ষার বলয় তৈরি করে ভাইরাসটিকে প্রতিহত করতে হবে। অর্থাৎ ভাইরাস যাতে মানবদেহে প্রবশে করতে না পারে বা কারও দেহে প্রবেশ করলেও যেন চারপাশ সংক্রমিত করার সুযোগ না পায়, সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। এ দায়িত্ব অনেকেই সঠিকভাবে পালন করতে পারছেন না। সরকার অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি দিয়েছে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য। তবে সরকার পক্ষের ভুল ছিল- ছুটি দেয়ার আগে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেয়া হয়নি। অবশ্য এর আগে থেকেই হোম কোয়ারেন্টিন ও লকডাউন শব্দ দুটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছে এবং বর্তমান সংকটে গুরুত্ব নিয়ে এর প্রচারণাও চলছে। কিন্তু আমরা অনেকেই এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারিনি বা চাইনি। আমরা ছুটির আনন্দে ছড়িয়ে পড়েছি। এভাবে আমরা ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছি। প্রবাসে থাকা কর্মজীবীরা দেশে ফিরে নিজের, পরিবারের, সমাজের মঙ্গলে যখন নিষেধাজ্ঞা মান্য করে নির্ধারিত দিনগুলোতে ঘরে আবদ্ধ থাকবেন, সেখানে তারা দোকানপাট-চায়ের স্টল দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন, বিয়ে করছেন আর এভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছেন সংক্রমণ; প্রশাসন খুঁজতে এলে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বুঝতে পারছেন না, এটি জেলে ভরার জন্য নয়- ঘরে থেকে সংক্রমণের ঝুঁকি কমানোর জন্য।

এসব সমস্যার পরও বলতেই হবে, এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে ভয়াবহভাবে ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েনি। যেহেতু এ প্রাণঘাতী ভাইরাস দমনের মতো ভ্যাকসিন বা ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি, তাই ভাইরাসকে নিজেদের আঙ্গিনায় ঢুকতে না দেয়াই হচ্ছে ভালো থাকার প্রধান উপায়। তাই স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী যা যা নির্দেশনা রয়েছে, তা অবশ্যই পালন করতে হবে। যেহেতু বিকল্প নেই এবং যেহেতু অনেকেই বিধি না মেনে অকারণে ঘরের বাইরে আসছেন; পোশাক শিল্পের মালিকরা টেনে নিয়ে এসেছেন বাইরে, তাই বৃহত্তর কল্যাণে নীতিনির্ধারকদের নতুন করে ভাবতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রয়োজনে হস্তক্ষেপ করতে হবে। যে কোনো উপায়ে বাধ্য করতে হবে ঘরে আবদ্ধ রাখতে।

বেশ কয়েকদিন আগে ফেসবুকে একজন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি নারীর চমৎকার একটি পোস্ট পড়ছিলাম। তিনি এ সংকটে তুলনামূলক বিচার করে বাংলাদেশের মানুষের প্রশংসা করছিলেন। তিনি জানালেন, প্রথমদিকে অস্ট্রেলিয়াতেও সাদা চামড়ার অনেকেই হোম কোয়ারেন্টিন মানেননি। রাস্তায় বেরিয়েছেন, সমুদ্রতীরে ঘুরেছেন। অবশেষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। তিনি বলেছেন, অস্ট্রেলিয়াতেও হোম কোয়ারেন্টিন ঘোষণার পর মানুষের মধ্যে খাদ্যশস্য মজুদ করার প্রবণতা ছিল। অনেক পণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। সে দেশে আপৎকালীন দুস্থ মানুষ সরকারের দিকেই তাকিয়ে থাকে। ব্যক্তি পর্যায়ে এবং বেসরকারি সংগঠন সাধারণত কোনো সাহায্য করার দায়বোধ করে না। অন্যদিকে বাংলাদেশে সরকার তার দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করলেও বসে থাকে না সাধারণ মানুষ ও পেশাজীবী। বিভিন্ন সংগঠনও ঝাঁপিয়ে পড়ে মানবিক দায়িত্ব পালন করার জন্য। এর মধ্যেই কথাটির সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। খেটে খাওয়া ঘরবন্দি মানুষের খাদ্য সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে এসেছেন নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা। এগিয়ে এসেছেন ক্রিকেটাররা, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। স্বল্প পরিসরে হলেও রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ মানবিক সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী অনেকেই অর্থ দিয়ে, হাসপাতাল বানিয়ে আর্তের সেবা করছেন। সরকার তো তার দায়িত্ব পালন করছেই।

তবে আমার মনে হয়, নীতিনির্ধারণে দূরদর্শিতার কিছুটা সংকট রয়েছে। কারণ করোনাভাইরাস থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রথম দায়িত্বই হচ্ছে ঘরে নিজেকে আবদ্ধ করা। অন্যদিকে, ঘরের বাইরে কাজের জন্য বের হতে না পারলে খাবার জুটবে না নিম্নআয়ের মানুষের। সুতরাং, খাদ্য সহযোগিতা নেয়ার জন্য যদি ট্রাকের পেছনে লাইন দিতে হয়, রিলিফদাতাদের যদি ঘিরে ধরে হাজারও মানুষ তাহলে ভাইরাসবিরোধী প্রতিরোধ থাকে কোথায়! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্থানীয় প্রশাসন ও আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন, তালিকা করে প্রত্যেকের ঘরে খাবার পৌঁছে দিতে। কিন্তু সর্বত্র তা তেমনভাবে পালিত হচ্ছে না। আবার রিলিফ তছরুপ করার ঘটনাও ঘটছে। অবস্থাপন্ন মানুষ তো প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে ঘরে আছেন। তাদের খুব প্রয়োজন নেই বাইরে যাওয়ার। বাজার খোলা আছে। প্রয়োজনে সওদাপাতি নিয়ে আসতে পারছেন। মধ্যবিত্ত পরিবার, যাদের খাদ্য ফুরিয়ে গেছে; তারা লজ্জা ও দ্বিধায় লাইনে দাঁড়াতে পারছে না। তাদের জন্য টেলিফোনে হটলাইনের ব্যবস্থা রয়েছে। সংকটে পড়ে টেলিফোন করলে বাসায় খাদ্য পৌঁছে যাবে বলে জানানো হয়েছে। তবে হোম কোয়ারেন্টিন বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে খেটে খাওয়া নিম্নআয়ের মানুষের জন্যই। এদের দু’দিন পরপর রাস্তায় এনে জটলা বাঁধানোর চেয়ে তালিকা করে প্রত্যেকের বাসায় এক সপ্তাহ চলার মতো খাদ্যশস্য পৌঁছে দিলে সংকট উত্তরণ সম্ভব হতো। এরপর কেউ বাইরে এলে বল প্রয়োগে হলেও ঘরে থাকা নিশ্চিত করা যেত। এ ধরনের কর্মসূচি নেয়াও হয়েছে। তবে সুষ্ঠু বণ্টনের বিষয়টি আরও নিশ্চিত করতে হবে।

আমার মনে হয়, এ সংকটে প্রত্যেকে যদি যার যার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করি, ঘরে নিজেকে আবদ্ধ রেখে ভাইরাসকে সংক্রমিত করার সুযোগ না দেই এবং হঠকারী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসি, তবে নিজে থেকেই ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যাবে করোনা। আমরা বিশ্বাস করি, এ লড়াকু জাতি জয়ী হবে। ওপারেই অপেক্ষা করছে স্নিগ্ধ সুন্দর জীবনের আলো।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্রঃ যুগান্তর

আলোকিত রাঙামাটি

সর্বশেষ