রাঙামাটি । মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ , ৯ বৈশাখ ১৪৩১

কাপ্তাই প্রতিনিধিঃ-

প্রকাশিত: ১৭:০২, ১৭ জানুয়ারি ২০২৩

​​​​​​​পঁচাত্তরেও মঞ্চ কাঁপাতে চান এই শিল্পী

কাপ্তাইয়ের যাত্রা শিল্পী রনজিত মল্লিকঃ

​​​​​​​পঁচাত্তরেও মঞ্চ কাঁপাতে চান এই শিল্পী
​​​​​​​সম্মাননা স্মারক হাতে অভিনেতা রনজিত মল্লিক।

আবহমান বাংলার চিরায়িত সংস্কৃতির অন্যতম একটি উপদান যাত্রাশিল্প। সামাজিক, ঐতিহাসিক, লোককাহিনী এবং ধর্মীয় প্রেক্ষাপটের উপর রচিত যাত্রাপালায় মানুষের সুখ-দুঃখের গল্প, পৌরাণিক ইতিহাস, জীবনবোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধ সহ নানা অনুষঙ্গে বিভিন্ন চরিত্র ফুটিঁয়ে তোলে অভিনেতারা।

কাপ্তাইয়ের একজন যাত্রাশিল্পী যিনি ৮শ’য়ের মতো যাত্রা, থিয়েটার এবং পথ নাটকে অভিনয় করেছেন প্রখ্যাত অভিনেতা পরিচালক রনজিত মল্লিক। যাকে গত ৩ জুলাই নাট্যঙ্গনে বিশেষ অবদান রাখায় কাপ্তাই উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক নাট্য সম্মাননা প্রদান করা হয়।

কয়েকদিন আগে কাপ্তাইয়ের চন্দ্রঘোনা কেপিএম কয়লার ডিপু আবাসিক এলাকায় অভিনেতা রনজিত মল্লিকের পুত্র বাউল শিল্পী বসুদেব মল্লিকের বাসায় কথা হয় এক সময়ের সাড়া জাগানো ওই অভিনেতার সাথে। ৭৫ বছর বয়সী এই অভিনেতা বয়সের ভারে অসহায় হয়ে পড়েছেন, ঠিক মতো এখন আর চলাফেরা করতে পারেনা, কথা বলতেও কষ্ট হয় এই অভিনেতার। নানা রোগ ব্যাধি বাসা বেঁধেছে শরীরে। স্মৃতিশক্তি অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবুও পুরনো স্মৃতি কিছুটা স্মরণ করেন।

তিনি জানান, ৭৫ বছরের এই জীবনে তিনি প্রায় ৮শ’ বিভিন্ন মঞ্চে যাত্রা ও নাটকে অভিনয় করেছেন। তার জীবনের প্রথম অভিনয় করা হয় ১৯৫৬ সালে। তখন মাত্র ৮ বছর বয়সে তার পিতা প্রয়াত অভিনেতা সতীশ মল্লিকের অনুপ্রেরণা নিয়ে চন্দ্রঘোনা কেপিএম হরিমন্দিরে দুর্গাপূজা উপলক্ষে একটি যাত্রাপালায় অংশ নিয়ে শুরু করেন অভিনয় জগৎ। যাত্রাটির নাম ছিলো ‘তরণীর বধ’। তরণীর বধে ছোট বালকের চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। সেই যাত্রাটির পরিচালক ছিলেন তৎকালীন কেপিএমে কর্মরত পরিচালক বিভুতী রঞ্জন বড়ুয়া। সেদিন তার অভিনয়ে খুশী হয়ে এক দর্শক তাকে ৫ টাকা পুরস্কার দেয়, যা তার জীবনের সেরা পুরস্কার বলে মনে করেন তিনি।

রনজিত মল্লিকের অভিনিত উল্ল্যেখ যোগ্য কয়েকটি যাত্রা পালা হলো- মানিকমালা, গরীবের মেয়ে, রাজসিংহাসন, রাঙা তলোয়ার, গৌরি মালা, জীবন্ত কবর, আলোমতি প্রেম কুমার। এছাড়া তিনি আরও অনেক যাত্রাপালা, থিয়েটার নাটক এবং পথ নাটকে অভিনয় করেছে। তবে যাত্রা পালায় তিনি সবসময় রাজার চরিত্রে অভিনয় করতেন বলে জানান। 

টেলিভিশন পর্দায় কাজ করার সুযোগও পেয়েছেন তিনি। বেসরকারি চ্যানেল এনটিভি’তে প্রচারিত ‘একটি কিনলে একটি ফ্রি’ নামক টেলিফিল্মেও তিনি একটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন। যাত্রাপালার পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মীয় পৌরানিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত নিমাই সন্যাস, সাবিত্রি সত্যবানসহ কয়েকটি পৌরাণিক নাটকে তিনি কখনও গায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, তার গানের গলাও বেশ সুমধুর।

দ্যা লেপ্রুসি মিশনের প্রযোজনায় বিশিষ্ট অভিনেতা জন অশোক বাড়ৈ'র পরিচালনায় কুষ্ঠ বিষয়ক পথ নাটক "আকাশ কুসুম" নাটকে পাগল চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন তিনি। যা দুই শতাধিক মঞ্চস্থ হয়েছে। রাঙামাটির কাপ্তাই, বিলাইছড়ি, রাজস্থলী, কাউখালী উপজেলা এবং চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, বোয়ালখালিসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়েও যাত্রা ও অভিনয় করেছেন এই গুণী অভিনেতা।

অভিনেতা রনজিত মল্লিক অভিনয়ের শিক্ষা জীবনে প্রয়াত বিশিষ্ট অভিনেতা বিভূতী রঞ্জন বড়ুয়া, শেখ মতিউর রহমান, আপ্রুসী কারবারী, জন অশোক বাড়ৈ, গোপাল ব্যানার্জীসহ অনেক গুণী পরিচালকের সাথে কাজ করেছেন।

অভিনয়ের পাশাপাশি রনজিত মল্লিক কাপ্তাইয়ের চন্দ্রঘোনা কর্ণফুলী পেপার মিলস হাসপাতালে দীর্ঘদিন চাকুরি করেছেন। তিনি বিগত ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটি থেকে অবসরে যান। অভিনেতা রনজিত মল্লিকের অভিনয়ের পাশাপাশি একজন পাল্টা কীর্ত্তনীয়া ও সংগীতশিল্পী হিসেবেও জনপ্রিয়তা আছে। এছাড়া তিনি নিজেও বেশ কয়েকটি যাত্রায় পরিচালকের ভূমিকা পালন করেছেন বলে তিনি জানান। অভিনেতা রনজিত মল্লিক অভিনয়ে স্বীকৃতি স্বরূপ কাপ্তাই  শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা, কেপিএম ম্যানেজমেন্ট থেকেও সংবর্ধনা পেয়েছেন।

কেমন কাটছে এই অভিনেতার বর্তমান জীবন জানতে চাইলে তিনি বলেন, একসময় অভিনয় করে জীবনে প্রথম তিনি ৫ টাকা সম্মানী পেয়েছিলেন। এরপর থেকে নামমাত্র সম্মানী কিংবা সম্মানী ছাড়াও ভালবেসে তিনি সারাজীবন অভিনয় করে গেছেন বলে জানান। টাকার জন্য নয়, বরং ভালবেসে অভিনয়কে আকঁঁড়ে ধরেছেন তিনি। বর্তমান সময়ে নাটক করে শিল্পীরা অনেক টাকা আয় করলেও তারা এমন সুযোগ পায়নি কখনও। তবুও ভালবেসে, কোনরকমে অভিনয়কে ধরে রেখেছিলেন। অভিনয় ছিলো তার একমাত্র ভালবাসা।

এদিকে বর্তমানে দুর্বীষহ জীবন কাটছে তার। বার্ধক্য জনিত সমস্যার কারনে তিনি চলাফেরা করতে এবং স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারেন না।

তিনি কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, যদি সুস্থ থাকি, তাহলে মৃত্যুর আগে আর একটি বার মঞ্চে অভিনয় করবো। ভবিষ্যতে যেন সকলের ভালবাসা ও আর্শীবাদ নিয়ে বাকী জীবনটা পার করতে পারেন সে আশা করেন তিনি।

অভিনেতা রনজিত মল্লিকের পুত্র বাউল শিল্পী বসুদেব মল্লিক জানান, আমার বাবা আমাদের আদর্শ। বাবার হাত ধরেই আমরা গান বাজনা শিখেছি।

কাপ্তাইযের এসময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা ও পরিচালক এবং কাপ্তাই উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির নাটক বিভাগের প্রধান আনিছুর রহমান জানান, অভিনেতা রনজিত মল্লিক হলো আমাদের প্রেরণার উৎস। তাদের দেখানো পথ ধরেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। তিনি রাজার চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করতেন।

সম্পর্কিত বিষয়: