রাঙামাটি । বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ , ১৩ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১১:৪৮, ২৫ মার্চ ২০২১

ভয়াল ২৫ মার্চ, বাঙালির জীবনের এক অভিশপ্ত রাত

ভয়াল ২৫ মার্চ, বাঙালির জীবনের এক অভিশপ্ত রাত

২৫ মার্চ রাতে ঘটে যায় বিশ্ব সভ্যতার এক জঘন্যতম গণহত্যা


মুক্তিকামী বাঙালির মনে তখন মুক্তির আকাঙ্ক্ষা তীব্র হচ্ছে। ওদিকে পাকিস্তানিরাও এই জনগোষ্ঠীর স্বাধিকার দাবি মেনে নিতে নারাজ। ১৬ মার্চ থেকে দফায় দফায় চলছে ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক। সাত কোটি বাঙালির দাবি আদায়ে অটল তিনি। সুপ্ত উত্তাল আগুনে ফুঁসছিল গোটা বাংলা। মুক্তিপাগল বাঙালি শুধু বঙ্গবন্ধুর মুখে চূড়ান্ত ডাকের অপেক্ষায়। দেড়শ মিনিটের সেই বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের জানান, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আরও আলোচনা হবে। তবে ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি। 

২৪ তারিখ সৈয়দপুর ও রংপুরে গণহত্যা চালায় পাকবাহিনী

 

ষষ্ঠ দফা বৈঠকের পরও কোনো সমাধান দেয় নি ইয়াহিয়া খান। এদিকে ২৪ তারিখে সপ্তম দফায় যে বৈঠক হওয়ার কথা তাও বাতিল করে দেন তিনি। ২৩ এবং ২৪ মার্চ সকাল পর্যন্ত পাক বাহিনী সৈয়দপুর ও রংপুর সেনানিবাসে গণহত্যা চালায়। এতে মারা যায় শত শত মানুষ এবং আহত হয় হাজার হাজার মানুষ। এইদিন সকাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে আন্দোলনরত জনতা ভিড় করতে থাকে। আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য তিনি বলেন, আমি কঠোর সংগ্রামের জন্য বেঁচে থাকব কিনা জানিনা, আপনার আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। তিনি বলেন, মানুষের মত স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকব, নয়তো সংগ্রামে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আরো বলেন, ‘আর আলোচনা নয়, এবার ঘোষণা চাই। আগামীকালের মধ্যে সমস্যার কোনো সমাধান না হলে বাঙালি নিজেদের পথ বেছে নেবে। আমরা সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। কোনো ষড়যন্ত্রই আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’ ভেতরে ভেতরে ইয়াহিয়া প্রস্তুত করছে তার বাহিনীকে। ২৫ মার্চ রাতের একটি চূড়ান্ত পরিকল্পনা তারা করে ফেলেছে ততক্ষণে। কিন্তু সহজ সরল বাঙালি জাতি তা খুনাক্ষরেও টের পায়নি। তারা মুক্তির জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে। এমন কিছু কল্পনাও করেনি কেউ। 

 

ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল একদল পিচাশ

 

২৫ মার্চ দিনের বেলাটা ঢাকায় ছিল বেশ থমথমে পরিবেশ। ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রে নিয়োজিত সামরিক বাহিনীর সৈনিকদের টেলিভিশন অনুষ্ঠানে হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রের কর্মচারীরা ধর্মঘট পালন করেছে। সেনাবাহিনী ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষ, রংপুরে কারফিউ। এদিকে মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা পণ্ড হয়ে গেছে- এ খবর দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ায় বীর বাঙালি ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে নেতার নির্দেশের অপেক্ষায়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার জন্য দেশবাসীকে আহ্বান জানান তিনি। বঙ্গবন্ধু বেশ কয়েকবার ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশে বক্তব্য দেন। নির্বিচারে গণহত্যার প্রতিবাদে কবি মোজাম্মেল হকের সামরিক সরকার প্রদত্ত ‘সিতারায়ে খেদমত’ খেতাব বর্জন।

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্টকে দেয়া সংবিধানের খসড়ার চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করা এবং অনুমোদনের জন্য সময় নির্ধারণের কথা ছিল এদিন। ইয়াহিয়ার সহযোগী জেনারেল এসজিএমএম পীরজাদা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ফোন করে জানাবেন। সারাদিন ধরেই আওয়ামী লীগের নেতারা টেলিফোনের অপেক্ষায়, কিন্তু সেই ফোন আর আসেনি।

 

বিশ্ব সভ্যতার এক জঘন্যতম গণহত্যা

 

এদিন সকালে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ভবনে একান্ত বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে ভুট্টো সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘পরিস্থিতি সঙ্কটজনক’।

ভুট্টোর সঙ্গে বৈঠকের পরই জেনারেল ইয়াহিয়া গোপনে বৈঠক করেন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের সামরিক প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান, চিফ অব জেনারেল স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান, মেজর জেনারেল মিঠঠা খান, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীসহ উচ্চপদস্থ সেনা কর্তাদের সঙ্গে।

এদিন বেলা ১১টার দিকে একটি হেলিকপ্টারে করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল জানজুয়া, মেজর জেনারেল মিঠঠা খান, মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহ ও মেজর জেনারেল ওমরসহ আরও কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা রংপুর, রাজশাহী, যশোর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম সেনানিবাস সফর করেন।

বিকাল থেকেই পাকিস্তানি সেনারা হেলিকপ্টারে টহল দিতে থাকে, সব ধরনের সামরিক সংস্থার সদস্যদের বার্তা দিতে থাকে অবশ্যম্ভাবী এক সামরিক অপারেশনের জন্য প্রস্তুত থাকতে।

প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান কোনো রকম ঘোষণা ছাড়াই গোপনে সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে সরাসরি বিমানবন্দরে চলে যান। তিনি নিরাপদে পশ্চিম পাকিস্তানে নামতেই পূর্ব পাকিস্তানে তৎপর হয়ে ওঠে তার বাহিনী।

 

ওই হত্যাযজ্ঞের নাম দেয়া হয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’

 

এদিকে ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগের খবর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পৌঁছে যায় বঙ্গবন্ধুর কাছে। রাত ৯টার দিকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে উপস্থিত দলীয় নেতা, কর্মী, সমর্থক, ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সামরিক ব্যবস্থার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে বেশি আগ্রহী।“এ অবস্থায় আমাদের পথ আমাদেরই দেখতে হবে। সবাইকে সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।”দাবানলের মত ঘরে ঘরে খবর পৌঁছে যায় যে ইয়াহিয়া ‘ঢাকা ছেড়ে পাকিস্তান পালিয়ে গেছে’। বাঙালি বুঝে ফেলে- কিছু একটা ঘটবে। রাতেই পথে নেমে আসে ছাত্র-জনতা এবং গড়ে তোলে অসংখ্য ব্যারিকেড। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা আত্মগোপনে চলে যান।

সন্ধ্যা নামতেই হয়তো পাকবাহিনীর প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। রাত ১০টার দিকে ঢাকা সেনানিবাস থেকে সেনাবাহিনীর একটি বড় কনভয় যুদ্ধ সাজে শহরের দিকে রওনা হয়। রাত সাড়ে ১১টায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হলো হনন-উদ্যত নরঘাতক কাপুরুষ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ছড়িয়ে পড়ল শহরময়। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে গর্জে উঠল অত্যাধুনিক রাইফেল, মেশিনগান ও মর্টার। নিরীহ মানুষের আর্তনাদে ভারী হলো রাতের বাতাস। মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণের মাধ্যমে পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুরু হলো বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ আর ধ্বংসের উন্মত্ত তাণ্ডব। হকচকিত বাঙালি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে। মধ্যরাতে ঢাকা পরিণত হয় লাশের শহরে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, নীলক্ষেতসহ বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে তারা বাঙালি নিধন শুরু করে।

ওই হত্যাযজ্ঞের নাম দেয়া হয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। অপারেশন সার্চলাইটের নীলনকসা অনুযায়ী আন্দোলনরত বাঙালীদের কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরোচিত ও নিকৃষ্টতম গণহত্যা শুরু করে। একাত্তেরর ২৫ মার্চের গণহত্যা শুধু একটি রাতের হত্যাকান্ডই ছিল না, এটা ছিল মূলতঃ বিশ্ব সভ্যতার জন্য এক কলঙ্কজনক এবং জঘন্যতম গণহত্যার সূচনা মাত্র।  

২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান।

আলোকিত রাঙামাটি

সর্বশেষ