রাঙামাটি । বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ , ১৩ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১১:১০, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২

বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মিথ, মিথ্যাচার ও অমীমাংসিত রহস্য!

বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মিথ, মিথ্যাচার ও অমীমাংসিত রহস্য!

১৯৭১ সাল। মেজর জিয়াউর রহমানকে প্রথমবারের মত কমলপুর অভিযানের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু জিয়ার ভুল সিদ্ধান্তের কারণে সেই অপারেশনে পাকবাহিনী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৭৮ জন মুক্তিযোদ্ধা সেনাসদস্যকে হত্যা করে। পিছু হটতে হয় মুক্তিবাহিনীকে।

মুক্তিযুদ্ধে একসাথে এত সংখ্যক সেনাসদস্য হত্যার ঘটনা ঘটেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালিত সকল অপারেশনে অব্যাহতভাবে সাফল্য এলেও কমলপুর অপারেশন ছিল ব্যতিক্রম। অপ্রত্যাশিত এ ঘটনায় মুজিবনগর সরকার, মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে ক্লোজ করা হয়।

১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদে বিএনপি নেতা উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ খান, তার বক্তব্যে ওসমানী কর্তৃক জিয়াকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়ার কথা বলেছিলেন। উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে সন্দেহজনক কর্মকাণ্ডের কারণে ১০ মে ১৯৭১, জিয়াকে গারো পাহাড়ের তেলঢালায় নির্বাসিতও করা হয়েছিল, যা মুক্তিবাহিনীর প্রথম এবং সম্ভবত একমাত্র শাস্তিমূলক পোস্টিং অর্ডার।

সকলে অবগত এমন হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ১৯৭১ সালের কমলপুর হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অপূরণীয় ক্ষতির অপর ঘটনাটি ঘটে ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। তবে ৭১ এর কমলপুর, ৭৭ থেকে ৮১ সাল পর্যন্ত ক্যু এর নামে হাজার হাজার সেনাসদস্য ও মুক্তিযোদ্ধা হত্যা বা ৯৪ সালের আনসার বিদ্রোহের সঙ্গে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পার্থক্য হচ্ছে - পিলাখানায় ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তা সহ ৭৭ জনকে হত্যার বিচার হয়েছে জনসম্মুখে এবং প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায়।

হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মিথ ও অভিমত:

দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, আমাদের একটি পক্ষ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে নিজেদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা আড়াল করতে, কেউ হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, আবার কেউ শুধুমাত্র বিরোধিতার খাতিরে মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এ অপপ্রচারের মাত্রা বলতে গেলে ভয়াবহ।

উইকিলিকস, আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থা এবং রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে এই মর্মে অভিমত প্রকাশ করেছিলেন যে, নবগঠিত সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে এ ঘটনা ঘটানো হতে পারে। ঘটনার সার্বিক পরিস্থিতি ও তথ্য প্রমাণ বিশ্লেষণ করলে এ নৃশংসতার নেপথ্যে এমন ধারণাই মেলে।

পিলখানা হত্যাকাণ্ড কেন্দ্রিক ভয়াবহ মিথ্যাচার ও অপপ্রচার:

যেকোনো দেশ জাতীয় দুর্যোগের ক্ষেত্রে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে দল-মত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে সঙ্কট মোকাবেলায় শামিল হয়। কিন্তু এদেশে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দোসরদের দায়মুক্তি দিতে যেভাবে অপপ্রচার চালানো হয় বা হয়েছিল, ঠিক একইভাবে পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়েও অপপ্রচার চলে আসছে। বিডিআর হত্যাকাণ্ডে সবাই যখন উৎকণ্ঠিত তখন বিএনপি নেতারা ভারত ও ইসরাইলকে ইঙ্গিত করে বক্তব্য দিয়েছিলেন। সাকা চৌধুরী, জামায়াত নেতা নিজামী ও মুজাহিদ প্রকাশ্যে ভারতকে দায়ী করে বক্তব্য দেন। তখন থেকে যেসব উদ্দেশ্যমূলক, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট অপপ্রচার চলছে তার কিছু উদাহরণ দিচ্ছি।

১. অপপ্রচার চলে, আওয়ামী লীগের অবগতিতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র' রৌমারি হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। অথচ রৌমারির ঘটনার সময় দায়িত্বরত বিডিআর প্রধান ফজলুর রহমান যে জামায়াতপন্থী তা অবসর গ্রহণের পর প্রকাশিত পায়। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি সরাসরি বিদ্রোহীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। তেহরান রেডিও ও চ্যানেল ওয়ানে দেয়া সাক্ষাৎকারে ফজলুর রহমান বিডিআর সৈনিকদের দাবিসমূহকে যুক্তিসঙ্গত বলে উল্লেখ করে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছিলেন। অপর একটি প্রচারণায় বিডিআর বিলুপ্ত করতে র’ এ ঘটনা ঘটিয়েছিল বলে প্রচার করা হয়।

এসব ভিত্তিহীন দাবির সমর্থনে উইকিলিকস, মইন ইউ আহমেদের লিখিত বইয়ের উদ্ধৃতিসহ যেসব সূত্র উল্লেখ করা হয় তার কোনটিতেই তাদের প্রচারিত বিষয়বস্তু নেই। শতভাগ মিথ্যার উপর ভিত্তি করে যে অপপ্রচার চলে তা পক্ষান্তরে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততারই ইঙ্গিত বহন করে।

২. প্রধানমন্ত্রী ২৬ ফেব্রুয়ারির ডিনার প্রোগ্রাম বাতিল করেছিলেন এটিও সমালোচনার ইস্যু। মোটামুটি শিক্ষা আছে এমন যে কেউ জানেন যে, কোনো বাহিনীর সঙ্গে সরকার প্রধানের ডিনার বা বৈঠক কোনো পাবলিক ইভেন্ট নয়, এর কোনো প্রেস-বিজ্ঞপ্তিও দেয়া হয় না। এছাড়া শিডিউল বাতিল করলে সেটি ২৪ তারিখ নয়, ২৫ তারিখে বাতিল করা হতো। কোন ধরণের সূত্র বা তথ্য প্রমাণ ছাড়া অভিযোগ তোলার রীতি বোধহয় পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে অপপ্রচারকারীরা।

২. হিতাহিত জ্ঞান শূন্য মিথ্যাবাদীর মত অপপ্রচার করা হয় যে, বিদ্রোহের আভাস পেয়ে নিরাপত্তার স্বার্থে ঘটনার ৫ দিন আগে প্রধানমন্ত্রী সুধা সদন ত্যাগ করে মেরামত চলমান যমুনায় (প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন) ওঠেছিলেন। কিছু প্রচারণায় যমুনার পরিবর্তে গণভবনে ওঠার কথা লেখা হয়েছে। প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, গণভবনের সংস্কার প্রয়োজন ছিল বিধায় তিনি প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত অপর সরকারি বাসভবন যমুনায় ওঠেছিলেন এবং এটিই স্বাভাবিক। আর বাসভবনে ৫ দিন আগে নয়, মন্ত্রিসভা সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় গেজেট প্রকাশের পর ৬ ফেব্রুয়ারি ওঠেছিলেন। দেশে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হলে দূতাবাস ছাড়া কোনো স্থানই ঝুঁকিমুক্ত নয় তা স্বার্থান্বেষী মহলের অজানা নয়।

৩. বিডিআর সংকটের সময় ভারতের সঙ্গে আলোচনা করার নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। ভারত আমাদের উন্নয়ন সহযোগী এবং বন্ধুপ্রতীম দেশ যারা মুক্তিযুদ্ধের সময়ও সহায়তার হাত প্রসারিত করেছিল। এ সংকটের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদ ও দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাও জড়িত। তাই ভারতের সঙ্গে আলোচনাকে বিতর্কিত করা অশুভ চিন্তাধারা। ভারতের সঙ্গে ফোনালাপ প্রসঙ্গ আনলে, যুক্তরাষ্ট্র কাছে এফবিআই ও যুক্তরাজ্যের কাছে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সহযোগিতা চাওয়ার প্রসঙ্গ কেন উল্লেখ করা হয় না?

৪. বিডিআর হত্যাকাণ্ড চলাকালে কোনো এক যাদু বলে তিন জন সেনা কর্মকর্তা নিরাপদ প্রস্থানে সক্ষম হন। অতঃপর দেখা যায় তারা অবসর নিয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে লন্ডনে অবস্থান করছেন ও হাস্যকর ভিডিও বার্তা দিচ্ছেন। তাদেরই একজন এবারের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীও হয়েছিলেন। গোলাম আযমের ছেলের শিষ্য বলে পরিচিত উক্ত ব্যক্তি প্রশ্ন তুলেছেন, সেনাবাহিনী তদন্তের নথি প্রকাশ করা হয় নি।

পৃথিবীর কোনো মিলিটারি তদন্ত প্রতিবেদন কখনোই পাবলিকলি প্রকাশ করা হয় না - এটি জেনেও না জানার ভান করা অজ্ঞতা বা অসততা। বিচারকার্যের জন্য যতটুকু তথ্য সরবরাহ করা প্রয়োজন ছিল তা আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছিল।

৫. বলা হয়, বিডিআর সদস্যরা জয় বাংলা স্লোগান দিয়েছিল, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা তোরাব আলীর প্রসঙ্গও উল্লেখ করা হয়। জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে, নৌকার ব্যাজ লাগিয়ে অপকর্ম করার কৌশল বহু আগে থেকেই চলছে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে বিডিআর অসন্তোষ সৃষ্টিতে বিপুল অংকের টাকা ছড়ানো হয়েছিল বলে জানা যায়। ষড়যন্ত্রের কুশীলবরা প্রতিপক্ষের তৃণমূল পর্যায়ের কাউকে কোনোভাবে সম্পৃক্ত করতে পারলে তাতে দায়মুক্তি মেলে না। বিএনপি নেতা নাসিরুদ্দিন পিন্টুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও হাজারীবাগের বিএনপি দলীয় কাউন্সিলর নাজনীন নেতাকর্মীদের নিয়ে দলীয় স্লোগান দিয়ে বিডিআর সদস্যদের সঙ্গে মিছিল করেছিলেন যার যথাযথ প্রমাণ আছে। নাজনীনের যেমন বিচার হয়েছে, তেমনি ছাড় দেয়া হয় নি তোরাব আলীকেও। অপরাধ করলে দলের কাউকে ছাড় না দেয়ার ব্যাপারে শেখ হাসিনা সর্বদাই অবিচল।

৬. সেনা অভিযান পরিচালনা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। বিদ্রোহীদের প্রতি শুরু থেকেই প্রধানমন্ত্রী কঠোর বার্তা দিয়েছেন। সেনা অভিযান পরিচালনা করা না হলেও ৪৬ ব্রিগেড প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অভিযানের জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। সাড়ে দশটার মধ্যে সেনাকর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়েছিল। অভিযান চালালে শতাধিক কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারকে জীবিত উদ্ধার সম্ভব হতো কিনা বা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কতটা বাড়ত তা অনুধাবনের জন্য সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক চিন্তার মানসিকতা প্রয়োজন।

৭. পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে ব্যারিস্টার তাপস ও জাহাঙ্গীর কবির নানককে সম্পৃক্ত করে বানোয়াট ও জঘন্য কল্পকাহিনী তৈরি করা হয়েছে যার নূন্যতম ভিত্তিও নেই। পিলখানা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার সাংসদ হিসেবে জনগণের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী তাদেরকে সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। অনেকে মহিউদ্দিন খান আলমগীরকে সম্পৃক্ত করেও মনগড়া কাহিনী লিখেছে, অথচ সে সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন সাহারা খাতুন।

সাহারা খাতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলেও গতিশীল তদন্তের স্বার্থে গঠিত কমিটিতে তাকে রাখা হয় নি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আওয়ামী লীগ কখনো সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে অপরাজনীতি করেনি। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর ৯৬ সালের জনতার মঞ্চ সংশ্লিষ্ট একজনকেও ছাড় দেয়নি বিএনপি। অন্যদিকে আ'লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিএনপিপন্থী হিসেবে চিহ্নিত একজনকেও চাকরীচ্যুত করে নি।

এখানে কয়েকটি অপপ্রচার তুলে ধরেছি মাত্র। বিএনপি জামাতের অপপ্রচারকারীদের বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা বা মেধা এতটাই নিচুস্তরের যে বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কল্পকাহিনী ছাড়া নূন্যতম বিশ্বাসযোগ্য সমালোচনাও তাদের পক্ষে করা সম্ভব হয় না। কিন্তু বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিএনপি জামায়াতের বিরুদ্ধে যে নির্ভরযোগ্য ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্যপ্রমাণ রয়েছে তার সন্তোষজনক জবাব কখনোই তারা দিতে পারবে না। মূলত এখানেই সত্য ও মিথ্যার প্রভেদ।

রহস্যাবৃত কিছু প্রশ্ন:

১. বিডিআর বিদ্রোহের দিন থেকে পরবর্তী দু'দিন খালেদা জিয়া কোথায় ছিলেন? ঘটনার আগের দিন তারেক রহমান লন্ডন থেকে রাত ১টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত ৪৫ বার খালেদা জিয়াকে কল করেন এবং সকাল ৬টার মধ্যে বাসভবন ত্যাগ করতে বলেন। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে এ তথ্যগুলো তুলে ধরেছিলেন। শেখ হাসিনা নির্ভরযোগ্য তথ্য ছাড়া এ জাতীয় ইস্যুতে কখনোই বায়বীয় তথ্য প্রদান করেন না।

বিরোধী দলীয় নেত্রীর বিরুদ্ধে তিনি অভিযোগ তুলেছিলেন সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ ও কল-রেকর্ডের সূত্র ধরে। এছাড়া সংসদে মিথ্যা বা অযাচিত তথ্য দেয়া হলে তার বিপরীতে প্রতিবাদের ভিত্তিতে বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করা হয়। তারেক রহমানের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলায় বিএনপি উকিল নোটিশ প্রেরণ করেছিল। তাদের উকিল নোটিশ পাঠানোর আরও নজির আছে। কিন্তু সংসদে উপস্থিত থেকেও বিএনপি প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উত্থাপিত অভিযোগের কোনো জবাব দেয় নি। কেন?

২. বিডিআর হত্যাকাণ্ডের আগে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দূত হিসেবে জিয়া ইস্পাহানী বাংলাদেশে আসেন। তিনি পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে যুদ্ধাপরাধের বিচার না করার অনুরোধ করেন। এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হয়েছিল। ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত করে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের প্রস্তাব দিলে জিয়া ইস্পাহানীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন শেখ হাসিনা।

যে ব্যক্তি ৩০ লাখ শহীদের রক্তের প্রতি উপহাস করার লক্ষ্য নিয়ে পাকিস্তান থেকে এসেছিল এবং প্রধানমন্ত্রী যার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে ২০ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার বৈঠক করার উদ্দেশ্য কি ছিল? জিয়া ইস্পাহানীর কার বা কাদের আহবানে বাংলাদেশে এসেছিল? আইএসআই ও বিএনপি-জামায়াতের উদ্দেশ্য ও স্বার্থ যে অভিন্ন এমন মনে না করার কোনো কারণ কি আছে?

৩. নির্বাচনে পরাজিত দলের সাধারণত প্রথমদিকে তেমন কোনো সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড থাকে না। কিন্তু ২০ ফেব্রুয়ারি অতীতের সকল ধারা ভঙ্গ করে বিডিআর বিদ্রোহের আগের দিন ২৪ ফেব্রুয়ারি সারাদেশ থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ঢাকায় আসার নির্দেশ দেয় বিএনপি। পরাজয়ের গ্লানি ও হতাশা দূর করে মনোবল ফিরিয়ে আনা যদি উদ্দেশ্য হয়, সেক্ষেত্রে একমাত্র প্রভাবিত করতে পারেন দলের প্রধান তথা খালেদা জিয়া। অথচ ২৪ ফেব্রুয়ারি আয়োজিত সভায় খালেদা জিয়া উপস্থিত ছিলেন না। বিকেলে বিএনপির সভা শেষ হয়, রাত থেকে শুরু হয় বিডিআর সদস্যদের ক্ষুব্ধ করার অপতৎপরতা। এ ঘটনাকে কাকতালীয় বলার কোনো সুযোগ কি আছে?

৪. পাকিস্তানের আবেদন প্রত্যাখ্যানের পর ও বিডিআর বিদ্রোহের চারদিন আগে জামায়াত নেতা মুজাহিদ দেশত্যাগ করতে চেয়েছিল। তাকে এয়ারপোর্ট থেকে ফিরিয়ে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তিনি কেন দেশের বাইরে যেতে চেয়েছিলেন?

৫. হত্যাকাণ্ডে নিজেদের সম্পৃক্ততার স্বীকারোক্তি দিয়েছেন এমন সদস্যদের মধ্যে সিপাহী মাঈন, সুবেদার মেজর গোফরান মল্লিক সহ অভিযুক্তদের বেশিরভাগ বিএনপি আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত। হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে যাওয়া ২২ জনকে টাঙ্গাইল থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এদের মধ্যে ১৪ জনের চাকুরীর সুপারিশ করে ডিও লেটার ইস্যু করেছিলেন ২১ আগস্ট গ্রেনেড মামলার আসামী ও বিএনপির উপমন্ত্রী সালাম পিন্টু। পিন্টুর সঙ্গেপাকিস্তানী জঙ্গি বাহিনীর সম্পর্ক, আইএসআই এর ঘনিষ্ঠতা ও অস্ত্র পাচারে সংশ্লিষ্টতা ভারত ও বাংলাদেশ, উভয় দেশের তদন্তে উল্লেখ রয়েছে। এ ঘটনাগুলোও কি কাকতালীয়?

৬. বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার পাঁচ বছর নৈরাজ্য, অরাজকতা, স্বেচ্ছাচার ও দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থেকে ২০০৬ সালে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু সেনাবাহিনীর কারণে উদ্দেশ্য সফল হয়নি। মইন ইউ আহমেদ, মে. জে. সাদিক হাসান রুমী সহ অনেক সেনা কর্মকর্তা জোট সরকারের অপকর্ম তুলে ধরেছিলেন। একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হতে ও দেশকে নেতৃত্বশূন্য করতে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার লক্ষ্যে ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। আর এ ঘটনায় ক্ষমতার শীর্ষ পর্যায়ের সংশ্লিষ্টতা আড়াল করতে সাজানো হয়েছিল জজ মিয়া নাটক।

খালেদা জিয়া ও যুদ্ধাপরাধী নিজামী ক্ষমতায় থাকাকালে জেএমবি ও জঙ্গিদের অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করে জঙ্গিবাদ মিডিয়ার সৃষ্টি বলে মন্তব্য করেছিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক দেশে জঙ্গি না থাকার দাবিকে মিথ্যা প্রমাণ করে যারা মুফতি হান্নান, বাংলা ভাই, শায়খ রহমান, আতাউর রহমান সানিসহ শীর্ষ জঙ্গিদের গ্রেফতার করেছিলেন, যারা জাতির সামনে জজ মিয়া নাটকের পর্দা উন্মোচন করেছিলেন, তাদের অন্যতম হলেন তৎকালীন বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কর্নেল গুলজার। এ ঘটনাগুলো বিএনপির জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর ছিল।

এছাড়া নিহতদের বেশিরভাগ ২০০৮ এর নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। বিডিআর প্রধানসহ নিহতদের অনেককে হত্যা করা হয়েছে অত্যন্ত নৃশংসভাবে। বিশেষ নির্দেশ ছাড়া এভাবে হত্যা মোটেই স্বাভাবিক নয়। তাই বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সমীকরণে বিএনপি-জামায়াতের ক্ষোভ, প্রতিহিংসা ও স্বার্থ কি উপেক্ষা করার মতো?

৭. আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের অল্প দিনের মাথায় সংগঠিত পিলখানা হত্যাকাণ্ডে ৫৭ জন চৌকস সেনা কর্মকর্তা ও তাদের পরিবার পরিজনসহ ৭৮ জন নিহত হন। মেজর জেনারেল শাকিল, কর্নেল গুলজারসহ নিহতদের প্রায় সকলেই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সমর্থক। এইচ এম এরশাদের ভাগ্নে ছাড়াও এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন তৎকালীন আইজিপি নূর মোহাম্মদের জামাতা ক্যাপ্টেন মাজহারুল হায়দার। এই সূর্যসন্তানদের হত্যার ফলে শুধু সেনাবাহিনী নয়, অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে সমগ্র জাতির। কিন্তু রাজনীতির পাল্লায় এ ক্ষতি কি আওয়ামী লীগের হয়নি?

৮. বিডিআর হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত আসামীদের পক্ষে যারা আইনি লড়াই করেছেন তাদের প্রায় সকলেই বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আসামীদের পক্ষে আইনি লড়াইয়ে অংশগ্রহণকারী আইনজীবীগণের মধ্যে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, ব্যারিস্টার রফিকুল হক, খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া ও মোঃ জয়নুল আবেদীন প্রমুখ বিএনপি'র নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতা।

যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর অন্যতম কৌঁসুলি এস এম শাহজাহান ও ফারুক আহমেদ সাবেক শিবির ও জামায়াত শিবিরের গ্রেফতারকৃতদের আইনি সহায়তা প্রদানকারী আইনজীবী। অন্যান্যদের মধ্যে টি এম আকবর, জামাল, জহিরুল আমিন, শফিকুল ইসলাম, সুলতানা আক্তার রুবি, শেখ রাশেদুল হক, মাজেদুর রহমান মামুন, এস এম রেফাজ উদ্দিন, আব্দুর রশিদ, খন্দকার জামাল, রমজান খান, আব্দুল মান্নান, হুমায়ুন কবির, এমদাদুল হক লাল, সুফিয়া আক্তার হেলেন, আমিনুর রহমান - এরা সকলেই বিএনপিপন্থী বার এসোসিয়েশনের নেতা বা জোট সরকার আমলের পিপি বা বিএনপির আইনজীবী প্যানেলের সক্রিয় নেতা। দলীয় সিদ্ধান্ত ছাড়া বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মত স্পর্শকাতর ইস্যুতে অভিযুক্ত খুনিদের পক্ষাবলম্বন করা কি স্বাভাবিক কোনো বিষয়? রাজনৈতিক স্বার্থ না থাকলে কি কেউ এমন হঠকারী পদক্ষেপ নিতে পারে?

বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শেখ হাসিনার সহনশীল, বুদ্ধিদীপ্ত ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। নিয়মতান্ত্রিকভাবে অভিযুক্তদের বিচার করার পাশাপাশি বিডিআরকে বিজিবি হিসেবে অত্যাধুনিক, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত একটি বাহিনীতে রূপান্তর করেছেন। আমাদের অর্জন অনেক। কিন্তু এই অর্জন যখন প্রগতি ও সমৃদ্ধিতে পরিণত হয় তখনই নেমে আসে কোনো অমানিশা। তাই সময়ের প্রয়োজনে, দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে মিথ্যা ও অপপ্রচার প্রতিরোধে সকলের সোচ্চার ও সচেতন হওয়া প্রয়োজন।

বিডিআর হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ ও ঘটনাক্রমে বিএনপি জামায়াতের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্টতার প্রচ্ছন্ন সমর্থন পাওয়া যায়। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একদিকে ঘৃণার আবাদ চলে, অন্যদিকে নির্দোষ, নিষ্পাপ জ্ঞান করে এক অর্থে ডিভিনিটি প্রদান করে ফলে রাজনৈতিক মেরুকরণে দায়মুক্তির সুযোগ পায়। তাই মর্মান্তিক বিডিআর হত্যাকাণ্ডে নিহতদের শান্তি কামনা ও নেপথ্যের কুশীলবদের অভিশাপ দেয়া ছাড়া আমার মত সাধারণের আর কিছু করার সুযোগ নেই।

সর্বশেষ