রাঙামাটি । শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ , ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ফিচার ডেস্কঃ-

প্রকাশিত: ১২:২১, ২৫ এপ্রিল ২০২২

জব্বারের বলীখেলা আজ, কী এর ইতিহাস?

জব্বারের বলীখেলা আজ, কী এর ইতিহাস?
জব্বারের বলীখেলা। ছবি : সংগৃহীত

বলীর রাজ্য হিসেবে পরিচিত ‘চট্টগ্রাম’। জব্বারের বলীখেলা সেই নামেরই প্রমাণ বহন করে চলেছে আজও। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কুস্তিকে বলী বলা হয়। জব্বারের বলীখেলা এক বিশেষ ধরনের কুস্তি খেলা, যা এ জেলার লালদিঘী ময়দানে প্রতি বছর ১২ই বৈশাখে অনুষ্ঠিত হয়। এই খেলায় অংশগ্রহণকারীদেরকে বলা হয় ‘বলী’। 

জব্বারের বলীখেলা একটি জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যমন্ডিত প্রতিযোগিতা হিসেবে বিবেচিত। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামী-দামি বলীরা এ খেলায় অংশ নিতেন। এই প্রতিযোগিতার শুরু ১৯০৯ সালে, যা আজও চলছে। বলীখেলাকে কেন্দ্র করে লালদিঘী ময়দানের আশে পাশে প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে বৈশাখী মেলার আয়োজন হয়। এটি বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকার সবচেয়ে বৃহৎ বৈশাখী মেলা।

মধ্যযুগে সেনাবাহিনীতে যারা চাকরি নিতেন, তাদের শারীরিক সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য তারা কুস্তি করতেন। সেখান থেকেই কুস্তি খেলার শুরু। কিন্তু জব্বারের বলীখেলার শুরুটা কিভাবে হয়েছিল? কিভাবে এই প্রতিযোগিতা স্থান করে নিয়েছিল সারা দেশের মানুষের মনে? সেসব ইতিবৃত্ত নিয়ে আজকের লেখা। 

সূত্রপাত ও নামকরণ

১৯০৯ সালে প্রথম এই প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আব্দুল জব্বার সওদাগর। তার মৃত্যুর পর এই প্রতিযোগিতা জব্বারের বলী খেলা নামে পরিচিতি লাভ করে। 

ইতিহাস

বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর এই দেশে ব্রিটিশ শাসন শুরু হয়। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং একই সঙ্গে বাঙালি যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর বলী খেলা বা কুস্তি প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন। ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ নিজ নামে লালদীঘির মাঠে এই বলীখেলার সূচনা করেন তিনি। ব্যতিক্রমধর্মী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার মিয়াকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।

 জব্বারের বলীখেলা। ছবি : সংগৃহীত


মল্ল পরিবার ও বলীখেলা

কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী স্থানের উনিশটি গ্রামে মল্লদের বসবাস ছিল। প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী মল্লরা সুঠামদেহী সাহসী পুরুষ ছিলেন। তাদের বংশানুক্রমিক পেশা ছিল শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন। এই মল্লবীররা ছিলেন বলিখেলার প্রধান আকর্ষণ ও বলিখেলা আয়োজনের মূল প্রেরণা। 

চট্টগ্রামের ২২টি মল্ল পরিবার ইতিহাস প্রসিদ্ধ। আশিয়া গ্রামের আমান শাহ মল্ল, চাতরি গ্রামের চিকন মল্ল, কাতারিয়া গ্রামের চান্দ মল্ল, জিরি গ্রামের ঈদ মল্ল ও নওয়াব মল্ল, পারি গ্রামের হরি মল্ল, পেরলা গ্রামের নানু মল্ল, পটিয়ার হিলাল মল্ল ও গোরাহিত মল্ল, হাইদগাঁওর অলি মল্ল ও মোজাহিদ মল্ল, শোভনদন্ডীর তোরপাচ মল্ল, কাঞ্চননগরের আদম মল্ল, ঈশ্বরখাইনের গনি মল্ল, সৈয়দপুরের কাসিম মল্ল, পোপাদিয়ার যুগী মল্ল, খিতাপচরের খিতাপ মল্ল, ইমামচরের ইমাম মল্ল, নাইখাইনের বোতাত মল্ল, মাহাতার এয়াছিন মল্ল, হুলাইনের হিম মল্ল, গৈরলার চুয়ান মল্ল বেশ নামকরা বলী ছিলেন। 

বলীখেলার স্মৃতিচারণ 

আব্দুল জব্বার সওদাগরের ছেলের ঘরের নাতি শওকত আনোয়ার বাদলের জন্ম ১৯৫৫ সালে। এই প্রতিযোগিতার শুরুটা না দেখলেও তার বাবার মুখে শুরুর দিককার অনেক গল্প তিনি শুনেছেন।

গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, ‘আমার দাদার মৃত্যুর পর আমার বাবা এর দায়িত্ব নেন। তিনিই এটার আয়োজন করতেন। আমরা যখন দেখেছি, তখন এই প্রতিযোগিতা এতটা প্রসারিত ছিল না। এটি শুধুমাত্র লালদিঘী এলাকার বলীদের জন্যই আয়োজন করা হতো।’

তিনি সেই সময়কার পরিবেশ বর্ণনা করে বলছিলেন, ‘আমি তখন স্কুলে পড়ি। সে সময় এলাকায় ঢোল বাজত, সঙ্গে থাকতো কুস্তিগীরেরা। আমরা ঢোলের পিছে পিছে ঘুরতাম। এভাবে তারা এসে মাঠে ঢুকত।’ 

সারা দেশের বলীরা কিভাবে যোগ দিলেন

খেলাটা কিছুটা প্রচলন হওয়ার পর আশেপাশের বলীরা সেই সময় মাস দুয়েক আগে এসে লালদিঘী ময়দানে জড়ো হতেন। জব্বার মিয়ার বাড়িতেই বড় একটা বৈঠকখানা ছিল। সেই ঘরেই থাকতেন তারা। সেখানেই তারা খাওয়া-দাওয়া করতেন এবং দিনভর নানা শারীরিক কসরত ও অনুশীলন করতেন, প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নিতেন।

ধীরে ধীরে চট্টগ্রামের নানা এলাকার বলী বা কুস্তিগীরেরা এই প্রতিযোগিতায় আসতে শুরু করেন। একসময় চট্টগ্রামের আশপাশের জেলা - নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ নানা জায়গা থেকেও বলীরা আসতে শুরু করলো। এরপর সারা দেশ থেকে আসতে শুরু করে। এমনকি একবার ফ্রান্স থেকে দুজন কুস্তিগীর এখানে অংশগ্রহণ করেছিল।

 জব্বারের বলীখেলা। ছবি : সংগৃহীত


সত্তরের দশক থেকে ধীরে ধীরে সারা দেশের বলীরা আসতে থাকে। যখন প্রথম টেলিভিশনে সম্প্রচার শুরু হয় তখনই এর সম্পর্কে সবাই আরো ভালোভাবে জানতে পারেন। 

বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আই প্রথম এর সম্প্রচার করেছিলো। এরপর এখন সকল টিভি চ্যানেল সম্প্রচার করছে। আর গণমাধ্যমের আগ্রহের কারণে জব্বারের বলীখেলা সম্পর্কে আরো প্রচার বাড়তে থাকে।

এখন যেভাবে হয় এই প্রতিযোগিতা

জব্বারের বলীখেলার সবচাইতে বেশি পরিচিত নাম কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলার দিদারুল আলম বা দিদার বলী, যিনি সব মিলিয়ে সাতবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। তিনি অবশ্য বর্তমানে অবসরে আছেন। তবে জব্বারের বলীখেলা থেমে যায়নি।

প্রতিবছর কম করে হলেও প্রায় দেড়শো কুস্তিগীর অংশগ্রহণের জন্য নাম লিখিয়েছেন। সারা বাংলাদেশে যত কুস্তিগীর আছেন, তাদেরকে এখানে আসতে সহযোগিতা করা হয়। তাদের এই প্রতিযোগিতায় কসরত প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া হয়।

এখানে পাঁচটি ধাপে প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে। প্রথম বাছাইয়ের পরের রাউন্ড পর্বে ৫০ জনকে নিয়ে খেলা হয়। সেখান থেকে ২৫ জন যায় মূল চ্যাম্পিয়ন পর্বে।

এখানে পয়েন্ট ব্যবস্থা নেই। কুস্তি করতে করতে মাটিতে যার পিঠ যে ঠেসে ধরতে পারবে সেই বিজয়ী হবে।

এছাড়া বলী খেলাকে কেন্দ্র করে তিন দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা চলে। দুর-দূরান্ত থেকে আসা বিক্রেতারা গ্রামীণ নানা সামগ্রী নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসেন। সেটিও মেলার অন্যতম আকর্ষণ।

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শতোর্ধ্ব বর্ষের লোক-ঐতিহ্য আবদুল জাব্বার সওদাগরের বলীখেলা। দেশপ্রেম ও স্বদেশী চেতনাকে সমুন্নত রাখে বলেই আজও এ অঞ্চলের মানুষের মনে জায়গা দখল করে আছে জব্বারের বলীখেলা।