রাঙামাটি । শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ , ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নিউজ ডেস্কঃ-

প্রকাশিত: ১৬:৫২, ১৫ জুন ২০২০

বাংলা কবিতায় বর্ষাবন্দনা: শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা

বাংলা কবিতায় বর্ষাবন্দনা: শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা

ছবি: সংগৃহীত


এ অঞ্চলে বর্ষাবন্দনা শুরু কালিদাসের মেঘদূত দিয়ে। বর্ষা বাঙালির জীবনে সৃজনঋতু; সর্বার্থেই। কৃষিপ্রধান অঞ্চলে ফসল সৃজনে বর্ষা যেমন প্রাণপ্রতিষ্ঠাকারী ঋতু, তেমনি সৃষ্টিশীলতার অঞ্চলেও। পদকর্তা জ্ঞানদাস থেকে শুরু করে আজকের কবিও বর্ষার রিমঝিম শব্দে বিমোহিত হয়ে সৃষ্টি করেছেন কবিতা। এভাবে বর্ষা কবিতার বিষয়-আশয় হয়ে উঠেছে। পদকর্তা বিদ্যাপতির, ‘এ সখি হামারি দুঃখের নাহিক ওর/ এ ভরা ভাদর মাহো ভাদর/ শূন্য মন্দির মোর’ কিংবা চণ্ডীদাসের ‘এ ঘোর যামিনি মেঘের ঘটা/ কেমনে আইলো বাটে/ আঙিনার কোণে তিতিছে বঁধুয়া/ দেখিয়া পরান ফাটে’ একইসঙ্গে রোমান্স ও বিরহের উচ্চারণ।

মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বর্ষাকাল’ কবিতায় প্রকৃতির বিচিত্ররূপের বর্ণনা করেছেন স্বল্প পরিসরে। প্রকৃতির স্বাধীনচেতা স্বভাবের চিত্র আঁকতে গিয়ে ‘রমণী রমণ লয়ে সুখে কেলি করে/ দানবাদি দেব, যজ্ঞ সুখিত অন্তরে’ দেখেছেন। প্রবল বর্ষণকে কবির মনে হয়েছে কলহপ্রিয়তার একটি বিশেষ রূপ। বর্ষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’র ‘গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা/ কূলে একা বসে আছি নাহি ভরসা’ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে মানসপটে ভেসে ওঠে একটি বর্ষণমুখর দিনের ছবি। মেঘের ঘনঘটায় আকাশ আচ্ছন্ন, তীরে প্রতীক্ষারত মানুষ আশাহত হয়ে উঠছে। ‘আষাঢ় সন্ধ্যা’য় মানব মনের হঠাৎ উন্মনা হয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গকে মহিমান্বিত করা হয়েছে। ‘হৃদয়ে আজ ঢেউ দিয়েছে, খুঁজে না পাই কূল/ সৌরভে প্রাণ কাঁদিয়ে তুলে ভিজে বনের ফুল’ বলে চিত্তের চাঞ্চল্যকে দিয়েছেন প্রশ্রয়, প্রকৃতিকে করেছেন তারই প্রযত্ন। 

‘বর্ষার রূপ’ মূলত ধারাপাতের নান্দনিক বিষয়কে কেন্দ্র করে, উদ্বেল কবির কাঙ্ক্ষাকে উন্মোচনের বিশেষ প্রচেষ্টা। তাই বলে উঠেছেন ‘কালো কল্পনা নিবিড় ছায়ার তলে/ ঘনায়ে উঠিছে কোন আসন্ন কাজে’। এই চিত্রকল্পে ঝড়প্রবণ সময়ের একটি ছবিকে ইঙ্গিত করে রচিত। এরকম ঝড়-বৃষ্টি কবলিত সময় মানুষ আপনাকে নিঃসঙ্গরূপে আবিষ্কার করে, অসংখ্য মানুষের ভিড়ে বসেও। তারই প্রতিধ্বনি এ কবিতা। সচেতন গৃহস্থের সংসার মনস্কতার প্রাত্যহিক চিত্র পাওয়া যায় ‘আষাঢ়’ কবিতায়। 

আসন্ন বৃষ্টির পূর্বাভাসে গৃহস্থ ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। তখন সবাইকে ডেকে ডেকে বলেন, ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে/ ওগো আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে’। কারণ, বাইরে প্রবল বৃষ্টি, কালি মাখা মেঘাচ্ছান্ন আকাশ। মাঠের গরু গোয়ালে আনার আকুতির সঙ্গে সঙ্গে খেয়াঘাটের মাঝির প্রসঙ্গও উত্থাপিত; সঙ্গে বর্ষণমুখর সময়ে পথ পিচ্ছিল হয়ে মানব চলাচলের জন্য বন্ধুর হয়ে উঠেছে তাও বর্ণিত। ফলে এ কবিতাটি পল্লীর বর্ষাকালীন প্রাত্যহিকতার চিত্র হিসেবে উজ্জ্বল।

রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত ‘সোনার তরী’র পর ‘নববর্ষা’য় নিজেকে উন্মোচিত করেছেন বেশি। এ কবিতা যতটা বর্ষার রূপ বর্ণনার স্মারক, ততধিক মনোভূমিরও। মনস্তাত্ত্বিক সংকট ও বিকলন এই কবিতায় প্রচ্ছন্ন। শুরুতেই তার প্রমাণ মেলে, ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মতো নাচেরে’ পঙ্ক্তিতেই। বর্ষার বিচিত্র সুর ও ছবির মিথস্ক্রিয়ায় ভাবুকমনে যে কল্পনা ও কল্পচিত্রের উদয় হয়, তাও এখানে ধরা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তার মনে হয়েছে, সমস্ত চরাচরের শেষ মানবচিত্তের চাঞ্চল্য ও প্রবুদ্ধির কাছে। বিশ্বপ্রকৃতির যাবতীয় রূপ ধারণ করে আছে পল্লীই। তাই, ‘তীর ছাপি নদী কলকল্লোলে এল পল্লীর কাছে রে/ হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে, ময়ূরের মতো নাচে রে’। তারও আগে বলেন, ‘নয়নে সজল স্নিগ্ধ মেঘের নীল অঞ্জন লেগেছে’। 

বিশ্বচরাচরকে বর্ষণমুখর মুহূর্তে অবলোকন করার একটি বিশেষ দৃষ্টি অর্জিত হয় সৃষ্টিশীল ব্যক্তির। তারই প্রতিফলন ঘটে তার কর্মে। কবিতার ক্ষেত্রে সে প্রতিফলনে প্রবুদ্ধির চেয়ে ভাবাবেগ বেশি; তারও বেশি ভাবালুতা। সে ভাবালুতাকে হৃদয়সংবেদীমাত্রই প্রশ্রয় দেয়; বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে না কবিতার এই মহান ত্রুটির বিপরীতে। এখানে ত্রুটিটুকু কি তবে চাঁদের কলঙ্কের মতো অনিন্দ্য সুন্দর কোনো প্রপঞ্চ হয়ে ওঠে? আর এই বর্ষাবন্দনার ক্ষেত্রে কবিচিত্ত কোনো এক অব্যাখ্যেয় কারণে যুক্তিরহিত হয়ে ওঠে; ফলে চিৎপ্রকর্ষের প্রশ্নে হয়ে ওঠে বল্গাহারা। প্রকাশ করে আপনচিত্তের সুখানুভূতিপূর্ণ প্রলাপও। বর্ষা বাঙালি কবিকে দিয়েছে তীব্র ভাবাবেগ, করে তুলেছে যুক্তিবিমুখ। অনেকটা বস্তুগত অর্থে কর্মবিমুখও। তার রেশ কবিচিত্ত ছাপিয়ে সাধারণ্যেও সঞ্চারিত। 

অমিয় চক্রবর্তী ‘বৃষ্টি’ শিরোনামে দুটি কবিতা লিখেছেন। একটির প্রথম পঙ্ক্তি বহুলপ্রচলিত, ‘কেঁদেও পাবে না তাকে বর্ষার অজস্র জলাধারে’। এ কবিতায় প্রকৃতির আচরণের সঙ্গে মানবাচরণের সাদৃশ্য কল্পনা করা হয়েছে। অন্যটির প্রথম পঙ্ক্তি, ‘অন্ধকার মধ্যদিনে বৃষ্টি ঝরে মনের মাটিতে’। এ কবিতায় সৃষ্টিশীল সত্তা মর্যাদাপূর্ণ দৃষ্টিতে চিত্রায়িত। এ জন্যই কবি উচ্চারণ করেছেন, ‘রচিত বৃষ্টির পরে, রৌদ্র মাটি, রুদ্রদিন, দূর/ উদাসীন মাঠে-মাঠে আকাশেতে লগ্নহীন সুর’। সৃষ্টির জন্য সময় নির্দিষ্ট করা থাকে না। যেকোনো মুহূর্তই সৃষ্টিশীল মুহূর্ত হতে পারে। তাই বৃষ্টি শারীরিক প্রয়োজনে হয়ে ওঠে তৃষ্ণা নিবারণের উপায়, মনোবিকলনে হয়ে ওঠে সুরের আয়োজন।

জসীমউদ্দীন ‘পল্লীবর্ষা’য় বর্ষার চিরায়ত রূপ অঙ্কন করেছেন। অবিশ্রান্ত ধারাপাতে পল্লীবাসী গৃহমুখী হয়ে পড়ে। অনেক সময় মাঠের কর্মচাঞ্চল্য থেমে যায়, শুরু হয় ঘরের কর্মযজ্ঞ। গৃহিণীদের নকশী কাঁথা বুননের উত্তম সময় এই বর্ষণমুখর বর্ষা। কৃষক মাঠে-ঘাটে কর্মযজ্ঞে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরলেও কৃষাণীরা ঘরকে করে তোলেন কর্মক্ষেত্র। ফলে ঘরই হয়ে ওঠে আঁতুড়ঘর। জসীমউদ্দীন দেখিয়েছেন এ সময় নারীরা সৃজনকর্মে সক্রিয় শিল্পী হয়ে ওঠে, ‘বউদের আজ কোনও কাজ নাই বেড়ায় বাঁধিয়া রশি/ সমুদ্র কলি শিকা বুনাইয়া নীরবে দেখিছে বসি /কেউবা রঙিন কাঁথায় মেলিয়া বুকের স্বপনখানি,/তারে ভাষা দেয় দীঘল সুতোয় মায়াবী নকশা টানি’। হয়তো সে নারীর মনের মানুষটি প্রবাসী, তার জন্য ভেতরে ভেতরে ডুকরে ওঠে মন। সে ক্রন্দন বৃষ্টির ধারাপাতের সঙ্গে ঐকতান তোলে। 

শামসুর রাহমানের ‘এমন বর্ষার দিনে’ রোমান্সপূর্ণ অনুভূতির সারাৎসার। আষাঢ়কে তার মনে হয়েছে প্রিয় নারীর মন এবং শ্রাবণকে হৃদয়। বর্ষার সঙ্গে নারীজীবনের মিলকেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন তিনি। কবিতাটি শেষ হয়েছে প্রশ্নশীল পঙ্ক্তিযোগে, ‘‘এমন বর্ষার দিনে তোমার কি সাধ জাগে কেউ/ নিরিবিলি টেলিফোনে ‘রাধা’ বলে ডাকুক তোমাকে?’’ তার ‘বৃষ্টি ধারায় দৃষ্টি মেলে’ একজন নিঃসঙ্গ মানুষের যন্ত্রণার কথা। তার ঘরে নারী রয়েছে, কিন্তু সে নারী তার কাছে অধরা, নিজেও অধরা সে নারীর জন্য। এমন বৃষ্টিমুখরদিনে তার শিল্পীসত্তা জেগে উঠেছে। তাই ফুটিয়ে চলেন ‘অচিন পদ্ম! ফুলের ঘ্রাণে হৃদয় মাতে’। 

বর্ষা কবির সৃজনপ্রক্রিয়াকে ক্রিয়াশীল রাখে। আল মাহমুদ সৃষ্টিমুখর বর্ষার রূপে কেবল বিমোহিত নন; সেসঙ্গে বর্ষায় আপন মনের গোপন কাক্সক্ষা প্রকাশেরও পথ বেছে নিয়েছেন ‘বৃষ্টির বিবৃতি’ কবিতায়। ‘আষাঢ়ের রাতে’ কবিতায় উপলব্ধি করেছেন, ‘ইথারে ঝিল্লির রব দীর্ণ করে আবহমণ্ডল’। সবুজের সমারোহে বৃষ্টি নিয়ে সৃষ্টিশীলতার আয়োজন। কবির আরাধ্য বিষয় ধরা দেয় এই বর্ষায়ই। বর্ষা তাই প্রিয় ঋতু কবির। বর্ষণমুখর মুহূর্তে কবি সৃষ্টিশীল, নিঃসঙ্গ ও বিষণ্ন হয়ে ওঠেন। ‘আষাঢ়ের রাতে’ কবিতায় সে উপলব্ধিই প্রকাশিত। 

শঙ্খ ঘোষ বর্ষাকে দেখেছেন মানবজীবনের আমূল পরিবর্তনকামী এক কারুকর্মীরূপে। ‘বৃষ্টি’ কবিতার পঙ্ক্তিজুড়ে তারই প্রমাণ রেখেছেন বুদ্ধি ও হৃদয়াকুতির সমন্বয়ে। বিপুল ধ্বংসযজ্ঞের ভেতর শঙ্খ ঘোষ দেখেছেন বৃষ্টির বর্ষণে ‘আজ ধ্বংস হয়ে যাবে সমস্ত যৌবন’ এবং শেষে উপলব্ধি করেছেন, ‘আমূল প্রপাত ভেঙে হীম নিশ্চলতা’ তার ‘শরীরে আজ ধর্ম হয়ে যাবে’। বৃষ্টির ধারাপাতের সঙ্গে তৃষ্ণার্ত মানবজাতির শারীরিক কাঙ্ক্ষাকে অভিন্নার্থে আবিষ্কার করেছেন। 

বিনয় মজুমদার বর্ষার ধারাপাতকে অন্ধকারের সঙ্গে মিলিয়ে একীভূত করে দেখেছেন, দেখেছেন সন্ধ্যার বৃষ্টির রূপও। ‘সন্ধ্যায় বৃষ্টি’ কবিতায় তাই তার সহজ উচ্চারণ, ‘সন্ধ্যায় প্রায়ান্ধকারে বৃষ্টিপতনের ধ্বনি শুনি’। এ কবিতায় বিনয় মজুমদার সহজ ভঙ্গিতে উচ্চারণ করেছেন সৃষ্টির পেছনের নিগূঢ় রহস্যের আড়ালে ধারাপাতের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এমন বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে তার নিজেকেও স্রষ্টা বলে মনে হয়, ‘বৃষ্টির দেবতা আমি এ জীবনে যত বৃষ্টিপাত/ করেছি সেসব কথা মনে পড়ে, ফলে বেঁচে আছি’। তার মতে বৃষ্টি সৃজনসহায়ক ও বীজতলা। শেষে উচ্চারণ করেছেন, ‘বৃষ্টিপতনের কথা কোনও দিন গোপন থাকে না’। সঙ্গত কারণে সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্বের কীর্তিও সাধারণ্যে সহজেই প্রচার পেয়ে যায়। তাই প্রকৃত শিল্পমাত্রই দৃশ্যান্তরালে থাকে না, মানবসমাজে তার প্রকাশ অবশ্যম্ভাবী।

আবার বিনয় মজুমদার ‘পয়লা শ্রাবণ আজ’ কবিতায় কালিদাসের উত্তরসূরি। কালিদাসের মতোই বলেন, ‘হে মুদ্রিত মেঘ যাও এ গিরিশিখর থেকে উড়ে যাও যেখানে পাঠাই/ সেই খানে দূতরূপে’। এর কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, ‘ঋতুচক্রকেই আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি’ বলে। এ কবিতায় সৃষ্টিশীল সত্তার অন্তর্বেদন যেমন প্রকাশিত, তেমনি বিরহযাতনাও। ফলে এ কবিতায় সৃষ্টিকালীন বেদনার সঙ্গে, খরাপীড়িত সময়ের যন্ত্রণাও প্রকাশ্য। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ‘কোলকাতার বুক পেতে বৃষ্টি’ কবিতায় বলেছেন, ‘চাইনি’ তবু হঠাৎ টগবগিয়ে ঘোড়ার ক্ষুরের মতো বৃষ্টির আগ্রাসন। যদিও বৃষ্টি আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ, তবু এই  বৃষ্টির প্রভাবেই প্রকৃতি সজীব হয়ে ওঠে। 

‘অবনী বাড়ি আছো’ কবিতায় বৃষ্টির প্রসঙ্গ একটি অনুপম চিত্রকল্পসহ প্রকাশিত, ‘বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস/ এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে/ পরাণ্মুখ সবুজ নালিঘাস/ দুয়ার চেপে ধরে/ ‘অবনী বাড়ি আছো?’ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে মেঘভরা আকাশের যে দৃশ্য মানসপটে ভেসে ওঠে তার সঙ্গে ফসলি ক্ষেতের সাদৃশ্য রয়েছে। বৃষ্টিউণ্মুখ আকাশের মেঘ যখন ভারী হয়ে আসে, তখন তাকে বিচিত্ররূপে দেখা যায়। সে দৃশ্যই কবির কাছে মাঠে-মাঠে চরে বেড়ানো গাভীর মতো মনে হয়েছে। ভাস্কর চক্রবর্তী বৃষ্টিবিলাসী নন। তার কবিতায় বৃষ্টি বিচ্ছেদের স্মারক হিসেবে উচ্চকিত। ফলে বৃষ্টি তার কাছে সব কিছু ভেঙেচুরে জীবন-জগতের মিলনরেখা ছিন্ন করার আয়োজন। বৃষ্টি এসে মানব জীবনের সমস্ত স্মৃতিচিহ্ন ধুয়ে দেয়। কবির কাছে তুলে ধরে ‘যেখানে আঁধারে/ মিনু আর ডলি আর/ মা আমার/ স্তব্ধ হয়ে আছে’। এভাবে মানব সংসারের চিরবিরহের স্মৃতিও বহন করে বৃষ্টি। তাই বৃষ্টি কেবল মানবসভ্যতায় সৃষ্টিশীল ধারাপাত নয়, ধ্বংসেরও কারণ। বর্ষাবন্দনায় বাঙালি মাত্রই সিদ্ধহস্ত। 

সৈয়দ শামসুল হকের ‘তুমুল বর্ষার দিনে’ কবিতায় মানবচিত্তের চাঞ্চল্য যেমন প্রকাশিত, তেমনি প্রবল বর্ষণধ্বনি আর মানবহৃদয়ের হাহাকার, ক্রন্দনধ্বনি একার্থক হয়ে ওঠে। সৈয়দ হক  সে ভাষ্যই রচনা করেছেন,‘কিছুটা আত্মার আর কিছুটা হাওয়ার/ হাহাকার!/ তুমুল বর্ষার দিনে বলা যাবে কোনটি তোমার?’ কবিকল্পনার কাছে নিঃসঙ্গ মানুষের উপলব্ধিজাত সত্য ও বর্ষার ধারাপাত একাকার হয়ে যায়। বৃষ্টি শেষে প্রিয়জন নিরুদ্দেশ হলে মনে হয়, ‘কাকের জটলা; খুব কর্কশ চিৎকার’। বৃষ্টিশেষের সময়কে প্রিয়জনের বিরহে কাতর মানুষের কাছে কাকের কর্কশ ডাকের মতোই মনে হয়। প্রতিটি ধ্বনিই তার অসহ্য। 

শহীদ কাদরীর কবিতার নাম, ‘বৃষ্টি, বৃষ্টি’। এ কবিতায় বৃষ্টির বহুমুখী কর্মযজ্ঞের বর্ণনা রয়েছে। বৃষ্টিকে সন্ত্রাসের সঙ্গে তুলনা করে দেখিয়েছেন এমন বৃষ্টিতে উন্মাদ, সন্ত্রাসীরা রাজত্ব করে। সাধারণ্যে নেমে আসে দুর্ভোগ। বৃষ্টি কেবল কল্পনাবিলাসীদের বিলাসিতার ঋতু নয়, নয় সৃষ্টিশীলতারও। বৃষ্টি ধ্বংসেরও ভয়াল ঋতু। ফরহাদ মজহারের কবিতা ‘বর্ষা’। শান্ত ও নিরুপদ্রব প্রান্তরজোড়া বৃষ্টিকে তার মনে হয়, ‘সবুজপ্রান্তরে ছুটছে দ্রুত বেগে একটি অপরূপ তীব্র নীল ঘোড়া’।  এ কবিতায় বর্ষা কেবল ঋতুচক্রের রীতি অনুযায়ী একটি বিশেষ ঋতুই নয়; মানবমনের গোপন কাক্সক্ষা প্রকাশেরও বিশেষ মুহূর্ত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। যে বর্ষা চরাচরে মানবদৃষ্টিকে ঘোলাটে করে দেয়, সে বর্ষার প্রবল ধারাপাত মানবমনকেও অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তোলে।

আব্দুল মান্নান সৈয়দ ‘শ্রাবণ’ কবিতায় বৃষ্টিকে আলোকধারার সঙ্গে তুলনা করেছেন। ‘বৃষ্টি ঝরে যাচ্ছে এক দ্যুতিশীল ঝাড়লণ্ঠনের মতো/ চতুর্দিক রৌদ্র-জ্বলা বরফের মতো শাদা এত আলো’। এবং শেষ পর্যন্ত বর্ষাকে সৃজনের কাল হিসেবে কল্পনা করেছেন, ‘আমারও সমস্ত সৃষ্টি/ নদী-উপনদী বেয়ে ধেয়ে চলে অগাধ সাগরে’। আবিদ আজাদ বর্ষাকে দেখেছেন কর্মমুখর দৃশ্যের ভেতর। ‘বৃষ্টি’ কবিতার প্রথম পঙ্ক্তি সে কর্মমুখর অঞ্চল ও সময়ের কথাই বর্ণনা করে, ‘টাপুরটুপুর টাইপরাইটারের শব্দে বৃষ্টি নামলো বৃষ্টি নামলো সারা মতিঝিলে’। এরপর কর্মজীবী মানুষের কর্মচাঞ্চল্যের সঙ্গে মানবচিত্তের অব্যাখ্যেয় অধ্যায় মেলে ধরেন। সে অধ্যায়ে উপরিতলের আপাতত নিস্পৃহতা ও কর্মচাঞ্চল্যের আড়ালে গোপন কাক্সক্ষারও সংবাদ মেলে। 

মানুষের বাইরের কর্মচাঞ্চল্যের সঙ্গে সঙ্গে মনের ভেতরের ঝড়কেও সমান গুরুত্বে বিবেচনা করা হয়েছে এ কবিতায়। আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিতা ‘বর্ষার হাওরে একদিন’। এ কবিতায় বর্ষা মৌসুমে নৌকাভ্রমণের ছলে কবি হয়ে উঠেছেন প্রত্নতাত্ত্বিক, ইতিহাসের মনোযোগী পাঠক। নিজের ভেতর সৃষ্টি করেছেন এক প্রশ্নশীল সত্তা। এবং একসময় তার সাধ জাগে, ‘হাওরে তলিয়ে যাব ঘুমে-ঘুমে, মিশে যাব জলের শরীরে’।  বর্ষণমুখর বর্ষায় নিজের ভেতরেও বৃষ্টি শুরু হলে জলের সঙ্গে একাকার হওয়ার ইচ্ছা জাগে।

এছাড়া শাহাদাৎ হোসেনের ‘আষাঢ়ের অভিযান’, ‘শ্রাবণে’,  নজরুলের ‘বাদল রাতের পাখি’, ‘বর্ষা বিদায়’, জীবনানন্দ দাশের ‘এই জল ভালো লাগে’, ‘ভিজে হয়ে আসে মেঘ’, ‘কেমন বৃষ্টি ঝরে’, ‘শ্রাবণ রাত’ উল্লেখযোগ্য বর্ষাবন্দনার কবিতা। বর্ষাবন্দনায় রচিত আরও কয়েকটি কবিতা, আব্দুল কাদিরের ‘শ্রাবণ শর্বরী’, সূফী মোতাহার হোসেনের ‘বরষা এলোরে ঐ’, ‘বিধুর বরষা’, ফররুখ আহমদ-এর ‘বর্ষায়’, ‘অঝোর ধারায় বৃষ্টি’, ‘শ্রাবণের বৃষ্টি’। বর্ষার ঘোর বর্ষণে শিল্পীমন নিঃসঙ্গ হয়ে ওঠে। তাই নিরালম্বের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় এই অমোঘ রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘শাঙন গগন ঘোরে ঘনঘটা নিশিথা যামিনীরে।’

আলোকিত রাঙামাটি

সর্বশেষ