রাঙামাটি । শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ , ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নিউজ ডেস্কঃ-

প্রকাশিত: ১১:২৯, ৪ জুলাই ২০২০

বকফুলের কাব্য

বকফুলের কাব্য

অলঙ্করণ: আনিস মামুন


‌‘সুবিনয় মুস্তফীর কথা মনে পড়ে এই হেমন্তের রাতে।
একসাথে বিড়াল ও বিড়ালের-মুখে-ধরা-ইঁদুর হাসাতে
এমন আশ্চর্য শক্তি ছিল ভূয়োদর্শী যুবার’। - জীবনানন্দ দাশ

শীর্ণকায় চেহারার। অযত্ন আর রোদ-বৃষ্টিতে অকারণ ঘোরাঘুরির কারণে গায়ের রঙ একটু তামাটে। কিন্তু মুখটা তার খুবই লাবণ্যময়। ফাতেমার কয়েক যুগ পূর্বের এক সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ যুবকের কথা মনে পড়ে গেল। অতীত ও বর্তমানের দুইজন ভিন্ন মানুষের চেহারার ভেতরে এত মিল থাকা সম্ভব? ফাতেমার ধারণার ভেতরেই ছিল না। প্রথম দর্শনেই সে নিশ্চিত যে, এই কিশোর আমজাদের সন্তান। মুহূর্তেই একটা প্রবল বাৎসল্যরস তার হৃদয়টাকে পূর্ণ করে দিল।

আমিনুলের ভেতরে কোনো সংকোচ, জড়তা, এমনকি ভয়-ডরও নেই। পার্থিব সকল কিছুতে স্থির ও নির্ভয় থাকাই তার বৈশিষ্ট। সুতরাং তার স্কুলের সল্প পরিচিত একটি মেয়ে তাকে যখন তাদের বাড়ির অন্দরমহলে ডেকে নিয়ে আসল, তখন সে বিন্দুমাত্রও বিচলিত হলো না। বরং একটা আবিস্কারের নেশা তাকে পেয়ে বসল।

বিকেলের আলোতে ফাতেমা উঠোনের ভেতরে একটা চেয়ারে বসেছিল। প্রতিদিন বিকেলেই সে এখানে এসে বসে। অন্দরমহলের পশ্চিম দিকের প্রাচীরের উপর দিয়ে রূপার ফিতার মত বয়ে যাওয়া যমুনা দৃশ্যমান এখান থেকে। তালুকদার বাড়ি পার হয়ে প্রায় আধামাইল পশ্চিমে গেলেই যমুনা নদী। নদীকে প্রস্থে অতিক্রম করলেই সারিয়াকান্দির চন্দনবাইশা, যেখানে এক সময়ে তাদের বাড়ি ছিল। এখন যমুনার অতলে। বিষয়টা ভাবতেই ফাতেমার চোখ আর্দ্র হয়ে ওঠে। তবু ফাতেমা প্রতিদিন বিকেলে এখানে বসে এবং নির্নিমেষ নয়নে যমুনার দিকে তাকিয়ে থাকে।

বাড়ির অভ্যন্তরে প্রবেশ করার পরই মেয়েটার মা অর্থাৎ ফাতেমাকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল আমিনুল। একজন ছবির মানুষের সঙ্গে বাস্তবের মানুষের এতটা মিল হয় কী করে! বয়স তার ভেতরে কিছুটা পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে বটে, তবে কখনোই ফাতেমার পূর্ব রূপে কোনো পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়নি। সে নিশ্চিত যে, এই মহিলারই কিশোরী বয়সের একটা সাদাকালো ছবি সে পেয়েছিল তার ঘরে রক্ষিত বাবার ‘চাহার দরবেশ’ বইটার ভেতরে। ঘরের দরজার উপরে স্থাপিত কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি পাটাতনের উপর থেকে। ছোটবোন আমেনার জন্মের বছর থেকে খরকা বিলের পারের উত্তর দক্ষিণমুখী ঘরটাতে আমিনুল স্থায়ীভাবে বসবাস করে, যেখানে শৈশবে আমজাদ বসবাস করত।

‘কী নাম তোমার?’, ফাতেমা নাম জিজ্ঞেস করতেই সম্বিৎ ফিরে পেল আমিনুল। কিন্তু কোনো প্রতিউত্তর করল না। স্মিতহাসি দিয়ে নিরুত্তর দাঁড়িয়ে রইল। পাশ থেকে ফাতেমার মেয়ে তার নাম বলে দিল।

ফাতেমার মেয়ে জানে আমিনুল কথা কম বলে। অথবা ইচ্ছে করেই কথা বলে না! তবে এটা নিয়ে স্কুলে কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হতে দেখেনি। স্যারদের পক্ষ হতেও না। স্কুলে আমিনুল তার চেয়ে দুই ক্লাস উপরে। অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণিতে। আসলে ছাত্র হিসেবে আমিনুল খুবই চৌকস ধরণের এবং প্রতিভাবান। ক্লাস সিক্সে এই স্কুলে ভর্তি হবার পর সবগুলো পরীক্ষাতেই প্রথম স্থান দখল করেছে। শুধু পড়াশুনা নয়। এথলেটিক্স, ফুটবল, ভলিবল সব ধরণের আউটডোর আইটেমগুলোতেই সে প্রথম হয়ে থাকে। এর বাইরেও দুটো বিষয়ে সে পারদর্শী - বাঁশি বাজানো ও ছবি আঁকা। তার বাঁশির সুর ছাড়া স্কুলের কোনো ‘বিচিত্রা অনুষ্ঠান’ই পরিপূর্ণতা পায় না। সম্ভবত বাঁশির সুরের কারণেই তার শব্দ করে কথা বলতে না পারার সীমাবদ্ধতাটা ঢাকা পড়ে গেছে। বন্ধুদের নিকটে সে কোনো উচ্চকিত মানুষের চেয়েও শব্দময়।

বিশেষ করে ছবি আঁকায় তার পারফরমেন্স দুর্দান্ত। অবশ্য বালিজুরি হাইস্কুলে আর্টের জন্যে কোনো বিশেষ ক্লাস নেই। শুধু বালিজুরি হাইস্কুলে কেন? ওই সময়কালে কোনো স্কুলেই ছবি আঁকার কোনো ক্লাস ছিল না। ছবি আঁকাকে কেউই তখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেননি। আমাদের দেশের দুই প্রখ্যাত শিল্পী জয়নুল আবেদিন এবং এস এম সুলতানের ছবি আঁকাতে হাত খড়িও সম্ভবত হয়েছিল যথাক্রমে যমুনার নির্জন তীরে ও নড়াইলের আত্ননিমগ্ন কোনো অশ্বত্থ গাছের ছায়ায়।

আমার ক্যাডেট কলেজের আর্ট শিক্ষক শিল্পী মুস্তফা আজিজ। বাংলাদেশের নামকরা স্কেচ শিল্পী। যশোরের শৈলকূপা থানার নির্জন মনোহরপুরেই যার হয়েছিল ছবি আঁকায় হাত খড়ি। আমার প্রায়ই মনে হয় মুস্তফা আজিজের মতো পেন্সিল স্কেচ করে প্রাকৃতজনদের মুখ ও জীবনকে প্রস্ফুটিত করে তোলা ভবিষ্যতের কোনো শিল্পীর পক্ষে আদৌ সম্ভব হবে কিনা। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নয়। প্রকৃতিই ছিল তাদের একান্ত গুরু।

সুতরাং বালিজুরি স্কুলে আর্টের ক্লাস না থাকলেও ছবি আঁকার প্রতিযোগিতা হতো নিয়মিত। প্রতিবছর ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে। বিশেষ ছবি আঁকার প্রতিযোগিতা। জামালপুর মহকুমা প্রশাসক নিজে আসতেন এই প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথি হিসেবে পুরস্কার বিতরণ করতে। প্রতিবারেই আমিনুল শ্রেষ্ঠ শিল্পীর সম্মানে ভূষিত হতো। এ পর্যন্ত পর পর তিনবার সে এই পুরস্কার পেয়েছে।

আমিনুল খরকা বিলের ধারে বা যমুনার পারে বসে ছবি আঁকে। বিশেষ করে বিকেলে যমুনার তীরে গিয়ে ছবি আঁকতে ভালোবাসে সে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একাধারে বসে এঁকেই যায়। কোনো নির্দিষ্ট মানুষ বা জন্তুর ছবি নয়। প্রকৃতি, খরকা বিল ও যমুনা নদীর তীরের মানুষদের জীবনযাপনের ছবি। জেলেদের মাছ ধরার ছবি। ধূ-ধূ দিগন্ত বিস্তৃত বালু অথবা কাশফুলের ছবি। শালিক পাখি বা বকের ছবি। নদীর বুকে ভাসমান পালতোলা পানসী নৌকার ছবি। পড়ন্ত বিকেলের খরকা বিলের ছবি।

শিল্পী জয়নুল আবেদিনের মতো পেন্সিল অথবা শিল্পী মোহাম্মদ সুলতানের মতো গাছ আর লতাপাতার রস দিয়ে তৈরি নানান ধরনের রঙ দিয়ে যখন সে একটার পর একটা ছবি প্রাণবন্ত ছবি আঁকত, তখন শুধুমাত্র তার সঙ্গীরাই নয়, স্কুলের শিক্ষকরা পর্যন্ত আশ্চর্য হয়ে যেতেন। আমি নিশ্চিত, বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়া পর্যন্ত চর্চা চালিয়ে গেলে আমিনুল একদিন নির্ঘাত বিখ্যাত শিল্পী হয়ে যেত।

আমার এক মামা যিনি আমিনুলের বাল্যকালের সঙ্গীদের একজন ছিলেন, তার কাছ থেকে আমি শুনেছি যে, আমিনুল ছবি আঁকার সময়ে তিনি প্রায়ই আমিনুলের পাশে বসে তার ছবি আঁকা দেখতেন। আমি তাকে বলতে শুনেছি, ‘আমি দেখতাম আমিনুল কীভাবে দ্রুত হাতে নিখুঁতভাবে প্রথমে পেন্সিলের দাগ দিত। অতঃপর তুলি চালাত সেই অস্পষ্ট দাগের ওপরে। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই, যেটা কয়েক মুহূর্ত পূর্বেও ছিল সাদা একটা কাগজ মাত্র, তা ভরে যেত অদ্ভুত সব জীবন্ত অবয়ব ও জলছবিতে। এখন বুঝতে পারি ওটা সাধারণ কোনো বিষয় ছিল না। ছিল নির্ভেজাল প্রতিভার ব্যাপার’!

ফাতেমার বাড়িতে রাত্রিযাপনসহ মহানন্দে এক বিকেল, এক রাত্রি ও এক সারাদিন কাটিয়ে দিল আমিনুল। তার প্রতি ফাতেমার আদরের সীমা পরিসীমা নেই। ঠিক যেন আত্মজ। আমজাদের ছেলে তার বাড়িতে এসেছে। পথভুলে! ফাতেমার ভেতরে মাতৃত্বের ভাব ছোটবেলা থেকেই খুব প্রবল। ঘুনাক্ষুরেও তার মনে হল না আমিনুলের তার বাড়িতে রাত্রিযাপন সম্পর্কে আমজাদকে অবহিত করার জন্যে সংবাদ পাঠানো উচিত।

আমজাদের প্রতি তার কিশোরী বা যুবতীকালের অনুভূতির প্রকৃতিকে ফাতেমা গভীরভাবে কখনোই খতিয়ে দেখেনি। হয়তো তা ছিল নিতান্তই বাৎসল্যরসে পরিপূর্ণ ভাইয়ের প্রতি বোনের অপত্য স্নেহ ভালোবাসার সম্পর্ক। অথবা অন্য কিছু, যা সম্পর্কে ফাতেমা কখনোই জানেনি! তবে আমজাদের দরবেশ চাচা সম্পর্কে যে তথ্যগুলো জানার তার আগ্রহ ছিল সেগুলো এখনো নিবৃত হয়নি। আমজাদের সঙ্গে তার কয়েক যুগ পূর্বের সেই আলাপচারিতা সম্পূর্ণ না হবার কারণে। নিজের মা’কেই দোষী মনে করে সে একারণে!

আমিনুলের হারিয়ে যাবার ক্ষেত্রে একটা ভিন্ন মাত্রা স্থাপিত হলো আজ! আসলে যে হারিয়ে যায়, সে বোধহয় কখনোই জানে না যে, সে হারিয়ে গেছে। তা না হলে পরদিন সন্ধ্যার দিকে আমজাদ যখন কয়েক যুগ পর প্রথমবার ফাতেমাদের বাড়িতে আসল পুত্রশোকে অস্থির হয়ে আমিনুলের খোঁজে, তখন আমিনুলের দৃষ্টিই আমজাদকে বলে দিচ্ছিল, ‘বাবা, আমি হারাইনি। বেড়াতে বেড়াতে এখানে এসেছি। এসে দেখ, ভালোই হয়েছে। কাকে আবিষ্কার করেছি আমি!’

প্রতিটি মানুষের জীবনের প্রথম দিকে অনেক স্বপ্ন থাকে। সেগুলোর মধ্যে কিছু স্বপ্ন থাকে যা খুবই পরস্পরবিরোধী। ফাতেমার বাড়িতে পদার্পণ করে আমজাদ জীবনে এই প্রথমবারের মতো দুই পরস্পরবিরোধী স্বপ্নের মধ্যিখানে নিজেকে আবিস্কার করল!

আলোকিত রাঙামাটি

জনপ্রিয়