রাঙামাটি । শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ , ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১১:১৩, ১৬ নভেম্বর ২০২১

দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তর

দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তর

“তুমি যেখানে বড় হয়েছো, সারাজীবন তার যে দুর্দমনীয় আর্কষণ, কখনও সেটাকে অস্বীকার তো দূরের কথা, কখনই তুমি এটার হাত থেকে নিস্তার পাবে না, তোমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে, বিশেষ করে সেখান থেকে তুমি যদি অন্যত্র সরে যাও”।- হাসান আজিজুল হক

দৃশ্যপট-১

আজ থেকে অর্ধ শতাব্দী পুর্বের কথা। শ্রাবণের বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় আমার জন্ম। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় পৌনে দুই শত কিলোমিটার দূরে। এক নিবিড় গ্রামে। জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ থানার কুমারপাড়া গ্রাম। অন্ধকারাচ্ছন্ন এক বাঁশঝাড় দ্বারা আচ্ছাদিত। নির্জন দুপুরে ঘুঘু ডাকে! বর্ষাকালে প্লাবিত হয়ে যায় প্রতিবছর। তখন জলের ওপরে ভেসে থাকা গ্রামটাকে দেখতে দ্বীপের মতন লাগে। অচেনা কোন দ্বীপ! পৃথিবীর বাইরের কোন জগতের! অথচ ফালগুণ, চৈত্র অথবা বৈশাখে এই এলাকা রৌদ্র দগ্ধ তপ্ত রাঢ় ভূমির মতন। পিপাসার্ত। শুকনো খটখটে। এক বাস্তব পৃথিবীর প্রতিচিত্র!

দৃশ্যপট-২

২০০২ সাল। পশ্চিম আফ্রিকার সিয়েরালিওন। রাজধানী ফ্রিটাউন থেকে অদূরে ‘গডরিচ’ নামক পাথরের নুড়ি দিয়ে তৈরি জায়গা। আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে। ব্যানসিগ-২। অর্থাৎ বাংলাদেশ সিগন্যাল ব্যাটালিয়ন-২। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে এসেছি আমরা। বাংলাদেশ থেকে আমাদের জীবনযাপন এখানেও ভিন্নতর নয়। ইউনিটের পাশে একটা বিশাল ডিম্বাকৃতির ক্ষেত্র। নুড়ি পাথরের তৈরী। লালচে বর্ণের! এখানেই সূর্যোদয়ের সময় থেকে প্রতিদিন আমরা পিটি করি। পিঁপড়ের সারির মতন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। ক্ষেত্রের কেন্দ্রস্থলে একটা ফুটবল মাঠ। এক বিন্দু ঘাসও নেই। শুধুই নুড়ি পাথর। এই মাঠেই কয়েক আফ্রিকান কিশোর খালি পায়ে ফুটবল খেলে। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি। আমাদের দিকে তারা কখনোই ভ্রুক্ষেপ করে না। আমার ছেলেবেলায় কাদার প্রান্তরের ভেতরে গামার অথবা জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলা শেখায় হাতখড়ির মতন। শৈশব এবং কৈশোরের কোন রকমফের নেই দেশ-কাল-পাত্র ভেদে!

দৃশ্যপট-৩

ফুটবল মাঠ অতিক্রম করলেই একটা উঁচু টিলা বা পাহাড়। এর চূড়ায় ‘মিলটন মার্গাই কলেজ অফ এডুকেশন এন্ড টেকনোলোজি’। সিয়েরালিওনের অন্যতম প্রধান বিদ্যাপীঠ। প্রতিদিন সকালের পিটি প্যারেড শুরু হবার পর অফিসারদের ওপরে কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তারা পাথুরে মাঠের ওপর দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে চলে যায় অ্যাটলান্টিকের তীরে। সম্ভবত জলের প্রতি মানুষের সহজাত আকর্ষণ থেকে।

এটাই আমাদের নৈমিত্তিক রুটিন। আমি আর ক্যাপ্টেন হাসিব। সেদিন সকালে আটলান্টিকের তীরে সাক্ষাত দুজন কলেজ ছাত্রীর সঙ্গে। কিশোরী। আবলুশ কাঠের মতন রঙ। খুবই উচ্ছল। আমাদের পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে! হাসিব আর আমি দুজনেই ভীষণ রকম বিস্মিত!কিছুটা শঙ্কিতও। আমরা দাঁড়িয়ে পড়তেই একজন স্মিত হাসি দিয়ে বলল, “ইউ অল বাঙ্গালিজ লুক এলাইক। ইট ইস রিয়েলি ডিফিকাল্ট টু ডিশটিঙ্গুইস ওয়ান ফ্রম এনাদার। দিস ইজ এমেইজিং!” হাসিবের সাথে আমার মিল খুঁজে পাবার কোন কারণ নেই। আমি গাঢ় শ্যাম বর্ণের। হাসিব উজ্জ্বল ফর্সা। পাকিস্তানের শহীদ আফ্রিদির মতন। আমাদের উচ্চতাও এক নয়। আমি বরং ভাবছিলাম এই মেয়ে দুটোর চেহারার ভেতরেই কোন পার্থক্য নেই! দুজনকেই মনে হচ্ছে আবলুশ কাঠের নিখুঁত প্রতিমুর্তি! আমি এতদিন মনে করতাম পৃথিবীতে সাদা চামড়ার মানুষ, মংগোলিয়ান এবং কালোদের চেহারারাই শুধুমাত্র এক রকমের হয়। অন্যদের নয়। বাঙালীদের চেহারাও যে অন্যদের কাছে একই রকম মনে হতে পারে সে সম্পর্কে আমার বোধোদয় এই প্রথম!

দৃশ্যপট-৪

তিন বছর পূর্বের কথা। আমার ছোট মেয়ে রাইয়াকে নিয়ে জামালপুর যাচ্ছি। আমাদের গ্রামে। ঢাকা-ভালুকা-জামালপুর রোড। রাস্তার দুইপাশে দিগন্ত বিস্তৃত বাংলাদেশ। সবুজে ঢাকা। কোন পার্থক্য নেই। যে কোন প্রান্তরের ভেতরেই গরু চরে বেড়াচ্ছে। যে কোন ডোবার ভেতরেই হাঁসেরা সাঁতার কাটছে! তাহলে আমার এলাকার সঙ্গে এই জায়গার পার্থক্য কোথায়? সবই তো একই রকমের দেখতে লাগছে! বিষয়টা আমাকে ভাবিয়ে তুলল। তার মানে কি এই যে বিদেশিদের চোখে যেমন আমার কোন স্বতন্ত্র চেহারা নেই, আমি শুধুমাত্রই একজন বাঙালি, তেমনি কি আমার জন্মস্থানও? ভালুকা, মুক্তাগাছা, ত্রিশাল যে কোন জায়গার মতনই কি আমার গ্রাম?

জামালপুর শহর পেরিয়ে পাঁচ রাস্তার মোড়। রশিদপুরের দিকে মোড় নিয়ে ঝিনাই নদীর ওপরের সাঁকো অতিক্রম করতেই মনে হল কোথাও একটা প্রানের টান জন্মাচ্ছে! বাংলাদেশের এই এলাকাটির সব স্থানে এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। একটা ব্রিজ অর্ধ সমাপ্ত হয়ে আছে অনেক দিন। পিলারগুলোর ওপরে অশ্বত্থ বৃক্ষেরা পল্লবিত হয়ে সবুজ ডানা মেলেছে! জায়গাটার নির্জনতা দেখে রাইয়া বলল, “পাপা, এই এলাকাতে যদি কখনোই বিদ্যুৎ না আসে, তাহলে কি একশো বছর পরও জায়গাটা এমনই থাকবে?” জায়গাটা তার খুব পছন্দ হয়েছে। আমার কাছে এই প্রশ্নের কোন সদুত্তর নেই। আমি মনে মনে ভাবতে থাকি, “থাকলেই অসুবিধা কি? অন্তত এই জায়গাগুলোতে অনেক বছর পরে যদি ফিরে আসি, তাহলে তো চিনতে অসুবিধা হবেনা!”

ঝাড় কাটা নদীর ওপরে বেইলি ব্রিজ। কিছুদূর যেতেই বালিজুরি। নতুন রাস্তা। এমপি মির্জা আজম তৈরি করে দিয়েছেন। ইলেক্ট্রিক পাইলনে পাইলনে ঝুলছে তারই জয়গান। এটা ভিন্ন পথ। এই পথে আমি ইতিপূর্বে কখনোই আসিনি। আমার ছোটবেলার গমনের পথ ছিল জামালপুর, মেলান্দহ, পয়লা, মাহমুদপুর হয়ে। শেষে ঝাড় কাটা নদী। তারপরেই আমার গ্রাম। অথবা হাজরা বাড়ি- মহিষ বাথান হয়ে ঝাড় কাটা নদীর স্নিগ্ধ জলে পা ডুবিয়ে বিনোদটঙ্গী- ঘুঘুমারি হয়ে। তালুকদার বাড়ির পাশ দিয়ে!

বালিজুরি থেকে ডানদিকে মোড় ফিরতেই চর নগর। অতঃপর বীর পাকেরদহ, চর পাকেরদহ, তেঘরিয়া এবং সবশেষে আমার গ্রাম। চর পাকেরদহ থেকে একটু উত্তরে গেলেই নব্বই চর, কাজলা চর, ডাকাত মারা চর। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সময়ে এই এলাকা হয়ে উঠেছিলো বিপ্লবী ছাত্রদের অভয়ারণ্য। এই পথটাই আমার চেনা। আমি কতবার আমার নানা বাড়িতে গিয়েছি এই পথ দিয়ে। পায়ে হেঁটে হেঁটে। চকচকে তপ্ত বালুর ওপর দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে। তবে চারপাশে এখন বিপুল পরিবর্তন। মাটির রাস্তাগুলো সব পাকা রাস্তা। যদিও বন্যা হলে পুনরায় ভেঙে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। প্রকৃতিই এখানে এখনো আসল নিয়তি। টিন বা ছনের বাড়িগুলোর অধিকাংশই প্রতিস্থাপিত হয়েছে এক তলা বিল্ডিং দ্বারা। এলাকার অধিকাংশ যুবকেরাই সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, দুবাই অথবা মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে চাকুরি করে। ফিরে আসে ঈদের সময়ে।

ঝাড় কাটা স্কুলের কাছে আসতেই আমি অবাক! স্কুল মাঠের চারদিকে খালেক জ্যাঠার লাগানো আমগাছ গুলোর প্রত্যেকটাই এখন এক একটা মহীরুহ। আমার বিশ্বাসই হল না যে, আমি একদিন এই স্কুলে পড়েছি। এতো ছোট লাগছে স্কুল বিল্ডিং এবং স্কুলের অঙ্গনকে। আমি যেন আলিবাবার যাদুর কার্পেটে চড়ে অনেক ওপর থেকে দেখছি আমার প্রিয় জন্মভূমিকে। ওপর থেকে সবকিছুই নয়নাভিরাম আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিন্দুর মতন লাগে!

শুধুমাত্র আমাদের পুরনো বাড়ির পেছনে আসতেই আমার ভেতরে স্বস্তি ফিরে এলো। রাস্তার পূর্ব পাশে প্রায়ান্ধকার একটা বাঁশবন। ঠিক আমার ছোটবেলাকার বাঁশবনের মতন! বাঁশঝাড় গুলোর মাথা রঙধনুর মতন রাস্তার ওপরে বেঁকে এসে ছৈয়ের মতন অর্ধ বৃত্তাকার আচ্ছাদন সৃষ্টি করেছে। বাঁশবন বন দিয়ে আচ্ছাদিত দুপুরের নির্জনতার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে মনে হল, “এই মুহূর্ত থেকে আমার জন্মভূমিকে ঠিক চেনা যাচ্ছে”! হয়তোবা একটা ঘুঘুও ডেকে উঠলো পাশ থেকে!

“একবার দু'-পহর অপরাহ্নে যদি এই ঘুঘুর গূঞ্জনে

ধরা দাও,-তাহ'লে অনন্তকাল থাকিতে যে হ'বে এই বনে” - জীবনানন্দ দাশ

আলোকিত রাঙামাটি

জনপ্রিয়