রাঙামাটি । শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ , ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ

প্রকাশিত: ১২:৫০, ১৭ মার্চ ২০১৯

মৃত্যুঞ্জয়ী 

মৃত্যুঞ্জয়ী 

‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না’। - বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (০৭ মার্চ ১৯৭১ সাল)।

আমাদের মহকুমা শহরের নাম জামালপুর। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে। আমার কুমার পাড়া গ্রাম থেকে জামালপুরের দূরত্ব ২০ মাইল। বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে ঝাড় কাটা নদী অতিক্রম করতে হয়। অতঃপর শক্ত মাটির তৈরি প্রধান সড়ক। মাহমুদ পুর হতে মেলান্দহ বাজার হয়ে জামালপুরের দিকে চলে গেছে। মাহমুদ পুর এবং মেলান্দহ বাজারের মাঝখানে যমুনার শাখা নদীর ওপরে পয়লা ব্রিজ। মেলান্দহ থেকে জামালপুর পর্যন্ত রেলগাড়ি চলে। এই রেল লাইনটা এসেছে মূলত ঢাকা হতে। মেলান্দহ, ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ হয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাটে চলে গেছে। মেলান্দহ আর জামালপুরের ঠিক মধ্যখানে ঝিনাই নদীর ওপরে ঝিনাই ব্রিজ। এই ব্রিজের ওপর দিয়েই রেলগাড়ি চলাফেরা করে। জামালপুর হতে মেলান্দহ বাজার পর্যন্ত রেল লাইনের সমান্তরালে একটা কাঁচা সড়কও রয়েছে। তবে এই পথে কোন গাড়ি চলে না। যারা ট্রেন মিস করে শুধুমাত্র তারাই হাঁটতে হাঁটতে জামালপুর চলে যায়। ঝিনাই নদীতে শরৎকালেও পানি থাকে। ছোট্ট ডিঙি নৌকায় করে সারাদিন চলে মানুষের পারাপার। নিস্তরঙ্গ এই জনপদের জীবন!

১৯৭১ সাল। বর্ষাকালের শেষ অথবা শরতের শুরু। জামালপুর শহর তখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং রাজাকারদের আড্ডাখানা। ট্রেনে করে পাকবাহিনী মেলান্দহ বাজার, ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জের দিকে চলে যায়। অতঃপর রাজাকারদের প্রদর্শিত পথ ধরে গ্রামের প্রধান সড়কগুলোর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো পুড়িয়ে দিয়ে চলে যায়।সম্ভাব্য কারণ দুটো। প্রথমত জনপদের ভেতরে ভীতি সৃষ্টি করা। দ্বিতীয়ত রাস্তার পার্শ্ববর্তী স্থানসমূহকে জনমানব, বাড়িঘর এবং বৃক্ষ শুন্য করে নিজেদের ভবিষ্যৎ চলাচলের পথে সুগম এবং নিরাপদ রাখা। মুক্তিযোদ্ধারা জলের কচুরিপানাকেও ঢাল বা কভার হিশেবে ব্যবহার করে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু সংখ্যক পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সদস্যদের প্রাণহানির কারণ হয়েছে।

শরতের শুভ্র সকাল। এক দিন প্রাতে হানাদার বাহিনী প্রথমে ট্রেনে এবং মালগাড়িতে করে মেলান্দহ বাজার পর্যন্ত আসল। অতঃপর জলপাই রঙের ট্রাক ও পিকাপে করে এসে মেলান্দহ থেকে মাহমুদপুর পর্যন্ত রাস্তার পাশের সকল ঘরবাড়ী পুড়িয়ে দিয়ে গেল। নদীর এপার থেকে আমরা সকল আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নিজ নিজ বাড়ী থেকেই দেখতে পেলাম এই দিগন্ত বিস্তারি খাণ্ডব-দাহন। ঝাড় কাটা নদী পেরিয়ে এই এলাকার সকল মানুষেরা চলে এসেছে আমাদের এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহে। মৌচাকের ওপরে মৌমাছির মতন গিজগিজ করছে মানুষজন!

আমাদের এলাকার মানুষজন প্রবল শঙ্কিত। বর্ষার পরে ঝাড় কাটা নদীতেও পানি কমে গেছে। চাইলে জল ডিঙিয়েই পাক বাহিনীর সদস্যরা আমাদের এলাকায় প্রবেশ করতে পারে। তবে সান্তনা এটাই যে, সম্ভবত তারা তা করবে না। কারণ সাঁতার না জানা হানাদার বাহিনীর সদস্যেরা জলাতঙ্কের রোগীর চেয়েও জলকে বেশি ভয় করে।তবে জামালপুরের রাজাকার আলবদরদের সাহায্যে তারা অনায়াসেই এই পর্যন্ত পৌঁছুতে সক্ষম হবে বলে গ্রামের বর্ষীয়ানদের ধারণা।

এই রকম দুর্যোগময় সময়ে চান চাচা বাড়ীর সকল কিশোর ও যুবাদের সবাইকে ডাকলেন। তিনি ঝাড় কাটা স্কুলের শরীরচর্চার শিক্ষক এবং ফুটবল মাঠের বিখ্যাত রেফারী। আমাদের এলাকায় যে মুক্তিযোদ্ধাদের দল এসেছে, তাদের অধিনায়কের সাথে তার প্রবল সখ্যতা। প্রায় দিন সকালেই আমি ঘুম থেকে ওঠার পর দেখতে পাই মুক্তিযোদ্ধাদের কোম্পানি কমান্ডারের সাথে তিনি নিবিড় আলাপচারিতায় মগ্ন। চাচা আমাদেরকে বললেন, “পাক বাহিনী যদি আমাদেরকে আক্রমন করে বসে তবে আমাদেরকে যুদ্ধ করেই মরতে হবে”। অতঃপর তিনি আমাদেরকে নির্দেশ দিলেন বাড়ির উঠোনের ভেতরে একটা মস্ত বড় পরিখা খনন করতে।বন্যা প্রবণ আমাদের এলাকার সকল বাড়িগুলোর ভিটেই সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৫-৭ ফুট উঁচুতে। চারপাশের কচুরিপানাতে পূর্ণ পগারগুলো প্রতিটা বাড়িকেই এক একটা সামরিক প্রতিরক্ষা অবস্থানে পরিণত করেছে। তবুও ঠিক অন্দর বাড়ীর উঠোনে এই গর্ত আমাদের কি কাজে লাগবে প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন, “যদি মরতে হয় তবে পুরো বাড়ীর সবাই আমরা এই পরিখার ভেতরে ঢুকে একসাথে মরবো।” তার কথার ভেতরে কতটুকু যুক্তি ছিল তা সেই বয়সে আমাদের কারুরই বিচার করার ক্ষমতা ছিলনা।বড়দের জন্যেও সেটা যুক্তির কোন সময় ছিল না। কাজেই ‘মরলে সবাই একসাথে মরব’ কথাটা আমাদের সবার ভেতরে প্রবল আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি করল। আমরা শিশু, কিশোর, আর যুবারা দিবারাত পরিশ্রম করে দুইদিনেই পরিখাটির খনন সম্পন্ন করলাম। আমাদের দেখাদেখি আশেপাশের বাড়িগুলোর প্রতিটিতেই গড়ে উঠল এক বা একাধিক পরিখা। এমনকি চারপাশের শুকিয়ে যাওয়া পুকুর আর পগারের পাড়গুলো ভরে গেল মাছরাঙা পাখির মতন শত শত পরিখা দিয়ে। যেন আমরা সবাই মিলে প্রস্তুত হচ্ছিলাম ইসলামের ইতিহাসের সেই ‘খন্দক যুদ্ধে’ অবতীর্ণ হবার জন্যে!

১৯৪২ সাল। যানুস কোরচাক। পোল্যান্ডের ‘ওয়ারশ’ শহরের একটি এতিমখানার মালিক। শিশুদের প্রচণ্ড রকমের ভালবাসেন তিনি। এতিমখানা হতে ২০০ শিশু এতিমকে ইহুদী নিধনযজ্ঞের অন্যতম মৃত্যুকুপ নামে পরিচিত ত্রেবলিঙ্কার অদূরে উঁচু পাচিলঘেরা একটা ঘেঁটোতে স্থানান্তর করা হয়েছে। যানুস কোরচাক জানেন যে, যথাসময়ে তাকে এবং তার এতিমখানার সকল শিশু এতিমদেরকে ত্রেবলিঙ্কার মৃত্যুকুপের অভ্যন্তরের গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে হত্যা করা হবে। কিন্তু এই অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুপথযাত্রী শিশুদেরকে তিনি কিভাবে মৃত্যুর বারতা শোনাবেন?

১৯১২ সাল। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন নাটক ‘ডাকঘর’। মৃত্যুপথযাত্রী এক বালকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এই নাটক লেখা হয়েছে। এই বালক তার আসন্ন মৃত্যুকে কৌতূহল, আবিস্কারের উচ্ছ্বাসে এবং বিমল আনন্দ নিয়ে বরণ করতে যাচ্ছে। কাহিনীটা অনেকটা এরকমঃ-

এতিম অমল মাধব দত্তের আশ্রিত একজন অসুস্থ বালক। মাধবদত্তের মাত্রাতিরিক্ত স্নেহ আর পরিচর্যার কারনে তার স্বাস্থ্য ক্রমঅবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। চার দেয়ালের বন্ধন ছেড়ে সে বাইরে যেতে চায়। চায় বাইরের ক্রীড়ারত বালকদের সাথে খেলতে। চায় তার ঘরের জানালার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া মালিনী কন্যা সুধার সাথে ফুল কুড়াতে। কিন্তু বাইরের বাতাসে অমল আরও অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে বিধায় কবিরাজের নির্দেশে ঘরের জানালাটাও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অমল তখন অতঃপর তার ঠাকুরদার কাছ থেকে জানতে পারে আশেপাশেই একটা ডাকঘর বসেছে কোথাও। এই ডাকঘর থেকে রাজার পক্ষ হতে তার কাছে চিঠি আসবে! এই চিঠির অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকে অমল। একদিন রাজদুত তার রাজকবিরাজ নিয়ে সত্যি সত্যিই অমলের ঘরে হাজির হয় এবং নির্দেশ দেয় ঘরের সমস্ত দরজা জানালা খুলে ফেলতে। মুক্তবাতাসে জ্বলজ্বলে তারার তারার নীচে অমল ঘুমিয়ে পড়ে। সুধা আসে ফুলের ডালা নিয়ে। অমল ঘুমিয়ে পড়েছে জানতে পেরে মাধবকে সুধা বলে যায় যেন সে অমলকে বলে যে সুধা তাকে ভোলেনি!

যানুস কোরচাক রবি ঠাকুরের এই নাটকের সাহায্য নিলেন শিশুদের কাছে নির্মম বার্তাটি পৌঁছানোর জন্যে। এতিমখানার শিশুদেরকে দিয়েই এই নাটকটার অভিনয় করালেন। শিশুদেরকে বোঝাতে সক্ষম হলেন কিভাবে আসন্ন মৃত্যুকেও হাসিমুখে প্রবল আত্নমর্যাদা সহকারে গ্রহন করা সম্ভব। বাস্তবেও তাই হয়েছিল। মৃত্যুর মুখোমুখি এসেও এই শিশুরা ছিল ধিরস্থির, পরিণত এবং আনন্দিত।

কোরচাক নাটকটি মঞ্চস্থ করেছিলেন ১৮ জুলাই ১৯৪২ সালে। এর মাত্র কদিন পর ৬ আগস্ট ১৯৪২ সালে কোরচাক, তার সহকর্মীদের এবং ২০০ শিশুকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ত্রেবলিঙ্কায়। তাদের মধ্যে না ছিল উদ্বেগ, না ছিল ক্রন্দন! তাদেরকে দেখা শেষ প্রত্যক্ষদর্শী জশুয়া পার্লে এর বর্ণনা অনুযায়ী, “Janusz Korczak was marching, his head bent forward, holding the hand of a child, without a hat, a leather belt around his waist, and wearing high boots. A few nurses were followed by two hundred children, dressed in clean and meticulously cared for clothes, as they were being carried to the altar.” — Joshua Perle, Holocaust Chronicles । এরপর আর কেউ কোনোদিন কোরচাক বা শিশুদের পুনর্বার দেখেনি!

অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকেও হাসিমুখে ও আত্ন মর্যাদা সহকারে প্রস্তুত হয়ে বরণ করা সম্ভবযদি সেই মৃত্যু সত্যিই গর্বের, আনন্দের বা মুক্তির হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যানুস কোরচাক, বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে সেই শিক্ষাই দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। এমনকি আমার সল্প শিক্ষিত চান চাচাও! যদিও তিনি কখনই কোরচাকের নাম শুনেন নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটক পড়ার সৌভাগ্যও তার কখনই হয়নি।

তিনি শুধু শুনেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চের ভাষণ!

আলোকিত রাঙামাটি