পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির পথে বড় বাঁধা জেএসএস
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর, বাংলাদেশ সরকার ও শান্তিবাহিনীর রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় ওরফে সন্তু লারমার সাথে স্বাক্ষরিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি।
পার্বত্য চুক্তির মুখবন্ধে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল অনুগত রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া তরান্বিত করা এবং বাংলাদেশের সকল নাগরিকের স্ব-স্ব অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার আধিবাসীদের পক্ষ হইতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নিম্নে বর্ণিত চারি খণ্ড (ক,খ,গ,ঘ) সংম্বলিত চুক্তিতে উপনীত হইলেন”। কিন্তু বাস্তবে চুক্তির পর সন্তু লারমা কোন শর্তই রক্ষা করেননি। বরং গত দুই যুগে তিনি উল্টো পথে হাটছেন। নিজে অস্ত্র জমা দেওয়ার নাটক দেখালেও জঙ্গলে রেখে এসেছেন তার সশস্ত্র সহকর্মীদের। তাদের হাতে রয়েছে বিশাল অস্ত্রের ভাণ্ডার। আর এই অবৈধ অস্ত্র দিয়ে সাধারণ মানুষের উপর স্টিম রোলার চালাচ্ছে। কখনো কখনো নিরাপত্তা বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করছে।
সন্তু লারমা শান্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরকারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করলেও বাস্তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে কাঙ্খিত শান্তি ফিরে আসেনি। বরং চুক্তির পরও খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে। চুক্তির পর পরই জেএসএসের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ মতবিরোধের কারণে জেএসএস ভেঙ্গে তৈরী হয় প্রসীত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ। পরবর্তী সময়ে অন্তর্কোন্দলের কারণে এ দুটি সংগঠন ভেঙ্গে চার টুকরো হয়ে যায়। বর্তমান জেএসএস (সন্তু), জেএসএস (সংস্কার), ইউপিডিএফ (প্রসীত) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এবং সর্বশেষ জেএলএ (মগ পার্টি) নামে এসব সংগঠনের ক্যাডার বাহিনী গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।
এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, গত ২৪ বছরে জেএসএস (সন্তু) এবং ইউপিডিএফ (প্রসীত) দলের আধিপত্যের লড়াইয়ে দুই হাজারের বেশি মানুষ খুন হয়েছে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী এ পর্যন্ত প্রায় আড়াই শতাধিক নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেয়ার ফলে পার্বত্যাঞ্চল ক্রমেই অরক্ষিত হয়ে পড়ে। যার ফলে পাহাড়ে বেড়েই চলেছে জেএসএস (সন্তু) লারমার সশস্ত্র সন্ত্রাসী তৎপরতা। যার প্রমাণ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদে ঢুকে প্রকাশ্য দিবালোকে একজন জনপ্রতিনিধিকে গুলি করে হত্যা।
- পাহাড়ে সংঘাত বন্ধে সরকারের সাথে নতুন শান্তির সংলাপের প্রস্তাব ইউপিডিএফ (প্রসীত) দলের
ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান ইন্সারজেন্সি ও উত্তেজনা নিরসনে সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় আগ্রহ প্রকাশ করে প্রসীত খিসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ গত ৯ জুন খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়িতে ইউপিডিএফ প্রসীতের পক্ষে সরকারের প্রতিনিধির কাছে একটি দাবীনামা পেশ করে। প্রস্তাবে বর্তমান শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারণের দাবি করা হয়েছে৷ প্রয়োজনে পাহাড়ের সব পক্ষকে নিয়ে সরকারের সঙ্গে সংলাপে বসতেও আপত্তি নেই জানানো হয়েছে৷
ইউপিডিএফ প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগের পক্ষে নিরন চাকমা কর্তৃক প্রচারিত এ বিবৃতিতে দাবী করা হয়েছে, চলমান সংলাপ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ইউপিডিএফ মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে সরকারের নিকট দলের দাবিনামা পেশ করেছে। ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের পক্ষে তাদের স্যোশাল মিডিয়া ফেসবুক পেইজে বিবৃতি দিয়ে এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৫-১৬ সালে ইউপিডিএফ (প্রসীত) ও জেএসএস (সন্তু) গ্রুপের সমঝোতা চুক্তির শর্ত ছিল একে অপরের সাংগঠনিক এলাকায় সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না। কিন্তু দীর্ঘ কয়েক বছর যাবত ধরে জেএসএস (সন্তু) দলের সশস্ত্র গ্রুপ ইউপিডিএফ (প্রসীত) দলের সাংগঠনিক এলাকায় অবস্থান করে আসছে। এ নিয়ে দু’দলের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে রেষারেষি ছিল। জেএসএস সদস্যদের পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চল ছেড়ে যাওয়ার দাবী জানিয়ে সাধারণ জনগণকে দিয়ে বহুবার মিছিল-সমাবেশ করিয়েছিল ইউপিডিএফ (প্রসীত) দল। ফলশ্রুতিতে রেষারেষি চরম পর্যায়ে পৌঁছায়।
এদিকে, ইউপিডিএফ সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার (৯ জুন) খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলাধীন ২নং চেঙ্গী ইউনিয়নের বড়কলক এলাকায় এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পানছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান শান্তি জীবন চাকমাসহ স্থানীয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিগণের উপস্থিতিতে ইউপিডিএফ (প্রসীত) দল সরকারের সাথে মধ্যস্থতাকারী মেজর (অবঃ) এমদাদুল ইসলামের কাছে চুক্তি আকারে তাদের ৬৯ পৃষ্ঠার ৮৭টি দাবীনামা পেশ করে। দাবীনামায় বেশীরভাগ চুক্তির সংশোধন বিষয়ে উল্লেখ করা হয়।
কিন্তু চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী জেএসএস (সন্তু) লারমার সাথে আলোচনা ব্যতীত উক্ত দাবীনামা পেশ করার ফলে জেএসএস (সন্তু) লারমা ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। এ নিয়ে গত (১০ জুন) তাদের দু’দলের মধ্যেকার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, কিন্তু উক্ত বৈঠক কোন সুরাহা ব্যতীত সমাপ্ত হয়। যার ফলশ্রুতিতে গত ১১ জুন ভোরে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার পানছড়ি উপজেলার চেঙ্গী ইউনিয়নের দুর্গম হরণসিং পাড়া এলাকা পাশ্ববর্তী দীঘিনালা উপজেলার নাড়েইছড়ির দুর্গম সিরেন্দি পাড়া এলাকায় জেএসএস (সন্তু) ও ইউপিডিএফ (প্রসীত) দলের মধ্যে ভয়াবহ এক গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় হতাহতের বিষয়ে পুরোপুরি কোন তথ্য নিশ্চিতভাবে না পাওয়া গেলেও একটি অসমর্থিত সূত্র বলছে, গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ৩-৫ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছে এবং তাৎক্ষনিক মৃতদেহগুলো সরিয়ে নেয় সন্ত্রাসীরা।
এ ঘটনার প্রতিবাদে দীঘিনালায় এলাকাবাসীর ব্যানারে জ্ঞান চাকমা ও রিটেন চাকমার নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। পানছড়িতেও ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত প্রতিরোধ কমিটির ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। একই দাবিতে রাঙামাটির সাজেক ও বাঘাইছড়ির পৃথক পৃথক স্থানে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সাজেকের বাঘাইহট ও মাচলং এ এবং বাঘাইছড়ি উপজেলা সদর এলাকায় পৃথকভাবে এই বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়।
এদিকে উপরোক্ত ঘটনার আলোকে সচেতন মহল মনে করছেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)’র সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় ওরফে সন্তু লারমাই পাহাড়ে অশান্তির মূল বিষ বৃক্ষ লালন করছেন। যখনই কোন আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর কোন পক্ষ পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকারের সাথে সংলাপের পথ তৈরী করে তখনই সন্তু লারমার দল জেএসএস বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তার নিয়োজিত সন্ত্রাসীরা শুরু করে পতিপক্ষের উপর সশস্ত্র হামলা। তখন উভয়ই পক্ষের সশস্ত্র লড়াইয়ে রক্তে রঞ্জিত হয় সবুজ পাহাড়। তাই এখন সময় এসেছে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে কাগুজে বাঘ সন্তু লারমাকে আঞ্চলিক পরিষদ থেকে অপসারনের। সাধারণ পাহাড়ি-বাঙালিদের মাঝেও দাবী উঠেছে, সন্তু লারমাকে হত্যা, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির জন্য গ্রেফতারের।’