রাঙামাটি । শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ , ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১১:৫৬, ২৯ এপ্রিল ২০২০

রসিকতা করলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী

রসিকতা করলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী

মিল্টন বিশ্বাস - ফাইল ছবি


করোনা ভাইরাস শনাক্তের জন্য গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবন করেছে ‘জিআর কোভিড-১৯ ডট বøট’ নামে এই র‌্যাপিড টেস্টিং কিট। কিন্তু ওই কিট নিয়ে গণস্বাস্থ্যের কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

কারণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে শুদ্ধতার (ভ্যালিডেশন) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হয়ে আসা পর্যন্ত এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে হৈচৈ করে কোনো লাভ নেই। যদিও গণস্বাস্থ্যের উদ্ভাবিত কিটের গবেষণা দলের প্রধান বিজ্ঞানী বিজন কুমার শীল বলেছেন ‘অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন এই দুইটির সমন্বয় করে কিট তৈরি করা হয়েছে। এটি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সুনির্দিষ্টভাবে করোনা ভাইরাস রোগী শনাক্ত করতে সক্ষম।’

এই নতুন কিটের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে করোনা ভাইরাস শনাক্তে ‘একশ’ ভাগ সফলতা পাওয়ার’ দাবি করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজেস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) প্রতিনিধির কাছে কিটের নমুনা দিয়েছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।

তাদের অভিযোগ, সরকারকে দিতে চাইলেও তা নিচ্ছে না। সরকারের কয়েকটি সংস্থার বিরুদ্ধে গণস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ কিট অনুমোদনে গড়িমসির অভিযোগও করেছে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ২৬ এপ্রিল এক জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে কিটটি কার্যকর কি না, তা সরকারকে পরীক্ষা করে দেখতে বলেন।

তিনি ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ তোলেন। তার মতে, কিটের ব্যাপারে সরকার ও ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরকে কেউ ভুল বোঝাচ্ছে।

গণস্বাস্থ্যের অণুজীববিজ্ঞানী ড. বিজন শীল অবশ্য সরকারের সর্বাত্মক সহযোগিতার কথা মিডিয়ায় প্রকাশ করেছেন। আসলে মহামারী দুর্যোগে করোনা নিয়ে যে কোনো গবেষণার ফলাফল আনন্দের এবং উৎসাহব্যঞ্জক হওয়াটাই স্বাভাবিক। দেশ ও দশের মঙ্গলের জন্য গবেষকরা কাজ করেন। তবে তা নিয়ে অনর্থক অভিযোগ এনে বিষয়টি হালকা ও রসিকতার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া একেবারে অনুচিত।

এর আগে জাফরুল্লাহ চৌধুরী ২৫ এপ্রিল টেলিভিশন টক শোতে নার্সদের নিয়ে ‘কট‚ক্তিমূলক’ মন্তব্য করেন। ‘নার্সদের ২য় শ্রেণির অফিসার পদমর্যাদা দেয়া ঠিক হয়নি। নার্সরা ঠিক মতো কাজ করে না। এ জন্য নার্সরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে না।’

স্বাধীনতা নার্সেস পরিষদ (স্বানাপ) থেকে প্রতিবাদ জানান হয় তার এই মন্তব্যের। কারণ চিকিৎসকদের পাশাপাশি নার্সরা জীবনের মায়া উপেক্ষা করে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।

ডাক্তার যেমন ৪০০ আক্রান্ত তেমনি কর্তব্য পালন করার সময় দুই শতাধিক নার্স করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নামটি বঙ্গবন্ধুর দেয়া, আর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জমিও দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। অথচ দেশের দুই সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং এইচএম এরশাদের সঙ্গে জাফরুল্লাহর ঘনিষ্ঠতা ছিল বেশি।

২৭ এপ্রিল ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক এক সংবাদ সম্মেলনে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অভিযোগের বিষয়টি জনগণের কাছে পরিষ্কার করে তুলে ধরেছেন। অসহযোগিতার অভিযোগ অস্বীকার করেন মহাপরিচালক।

২১ এপ্রিল পর্যন্ত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ তাকে যেসব চিঠি দিয়েছে তাতে সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা হয়েছে। কোনো কিছু আবিষ্কার করলে তা অনুমোদন করিয়ে নিতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, এজন্য একটা নির্ধারিত পদ্ধতি রয়েছে।

ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর, কিট অনুমোদনের প্রক্রিয়াটি জাতিকে জানিয়েছেন এভাবে নিয়ম অনুযায়ী, একটি কন্ট্র্যাক্ট রিসার্চ ফার্মের (সিআরও) সঙ্গে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে চুক্তিবদ্ধ হয়ে প্রটোকল তৈরি করতে হয়। প্রটোকলে কিটটি কার্যকর কি না, সেটির ট্রায়াল কীভাবে হবে, কতজনের ওপর হবে, কত সময়ের মধ্যে হবে, সে বিষয়গুলোর উল্লেখ থাকে।

বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ সেন্টার (বিএমআরসি) থেকে উৎপাদন প্রক্রিয়া যথাযথ ছিল কি না, সে সম্পর্কিত মূল্যায়ন হওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। ওষধ প্রশাসন অধিদফতর ট্রায়ালের কাগজপত্র ও বিএআরসির মূল্যায়নপত্র খতিয়ে দেখে বিপণন বা বাজারজাতকরণের অনুমতি দেবে।

অধিদফতরের যে কমিটি অনুমোদন করে থাকে, সে কমিটির সদস্যরা বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষ। উল্লেখ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা র‌্যাপিড টেস্ট সুপারিশ না করলেও যেহেতু বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা গবেষণা করছেন বলেই ঔষধ প্রশাসন সব ধরনের সহযোগিতা করেছে। বিদেশ থেকে রিএজেন্ট আনার অনুমতির পর গবেষণাগারে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ সবকিছুই সুন্দর প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়।

তবু জাফরুল্লাহ চৌধুরী ঔষধ প্রশাসন সম্পর্কে নানা ধরনের অপপ্রচার করেছেন। তিনি অযাচিতভাবে অসত্য তথ্য উপস্থাপন করে প্রতিষ্ঠানকে হেয়প্রতিপন্ন করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে করোনা ভাইরাস শনাক্তে অনুমোদনহীন কিট ব্যবহার করা যাবে না।

ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান ২৬ এপ্রিল বলেছেন, যেহেতু এই কিট এখনো অনুমোদিত নয় বলেই এটা হস্তান্তর হতে পারে না। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে ‘অপপ্রচার’ না করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। যেহেতু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা র‌্যাপিড কিটের অনুমোদন কোনো দেশের জন্য এখনও দেয়নি ফলে তারাও এখনই দিতে চাচ্ছেন না।

অন্যদিকে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে কাজ করে যাওয়া চিকিৎসকদের মতে, রক্ত পরীক্ষা করে কোভিড-১৯ শনাক্ত করার পদ্ধতি এখনো গ্রহণযোগ্য নয়। পিসিআর পদ্ধতিতে নমুনা হিসেবে রোগীর লালা কিংবা শ্লেষ্মা পরীক্ষা করে রোগ নির্ণয়কেই এখন পর্যন্ত শতভাগ সফল বলে ধরা হচ্ছে। নাক দিয়ে শ্বাসপ্রণালী থেকে এটা নিতে হয় বলেই ডাক্তারও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। অবশ্য এ পর্যন্ত আক্রান্তদের মধ্যে অর্ধেকেরও রক্তে ভাইরাস পাওয়া যায়নি অথচ তারা করোনা পজিটিভ। এজন্যই র‌্যাপিড টেস্ট কিটের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

পিসিআরের সমমূলক সেনসেটিভ হলে সেই ডেটা চিকিৎসা বিজ্ঞানীদেরও দিতে হবে। অর্থাৎ করোনা ভাইরাস শনাক্তে সন্দেহভাজন ব্যক্তির রক্তের নমুনা পরীক্ষার জন্য গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্ভাবিত কিটের সাফল্য এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আশ্চর্য হলো এই কিট নিয়ে সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করার পর জাফরুল্লাহ চৌধুরী দেশের কিছু প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিষোদগার করেছেন। করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় তার সাহায্য দরকার হতে পারে কিন্তু তাই বলে তিনি সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে মিথ্যাচার করতে পারেন না।

এ কথা সত্য র‌্যাপিড টেস্টের কিছু কার্যকারিতা আছে। রক্তের নমুনায় অ্যান্টিবডির উপস্থিতি শনাক্ত করার জন্য এগুলো কাজে লাগে। তবে মহামারীর এই দুর্যোগে এ ধরনের পরীক্ষার কিট অনেক দেশ তৈরি করলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(হু) ও বিভিন্ন দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা তা ব্যবহারের অনুমতি দেয়নি।

কারণ কেউ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার রক্তে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে পাঁচ থেকে ১০ দিন সময় লাগতে পারে। ফলে, অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার আগে র‌্যাপিড কিটে নমুনা পরীক্ষা করা হলে ফলাফল নেগেটিভ হবে। অর্থাৎ, শরীরে ভাইরাস থাকলেও এই পরীক্ষায় তা ধরা পড়বে না। আবার কেউ আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে উঠলেও তার রক্তে অ্যান্টিবডি থেকে যাবে। ফলে তার শরীরে ভাইরাস না থাকলেও র‌্যাপিড কিটের টেস্টের ফলাফল পজিটিভ আসবে।

অ্যান্টিবডি পরীক্ষায় সঠিক ফল না পাওয়ায় ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশেই র‌্যাপিড কিট দিয়ে পরীক্ষা বন্ধ করা হয়েছে। কারণ যে উদ্দেশ্যে এটা করা হচ্ছে সেই উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে না। সেজন্যই দরকার ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা। দেশের নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসকদের মতে, এই মুহূর্তে সন্দেহভাজন রোগীর করোনা ভাইরাস আছে কি না সেটা জানা দরকার।

আমাদের কত শতাংশ লোক কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন, সেটা এই মুহূর্তে দরকার নেই। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র সবাই পিসিআর মেশিন দিয়ে কাজ করছে। এজন্য জাফরুল্লাহ চৌধুরী হাপিত্যেশ করলেই হবে না। যৌক্তিক কথা বলতে হবে তাকে।

বিজ্ঞানীদের মতে, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ‘জিআর কোভিড-১৯ ডট ব্লট’ নামে এই র‌্যাপিড টেস্টিং কিট প্রচলিত পিসিআরের সঙ্গে তুলনা করতে হবে। এজন্য এন্টিজেন স্ট্রাকচারের ডেটা দিতে হবে, পেটেন্ট হয়েছে কি না, পিয়ার রিভিউ হয়েছে কি না এসব বিবেচনায় আনতে হবে। মানব শরীর নিয়ে চিকিৎসার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা একটি জরুরি বিষয়। এজন্য পরীক্ষার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টকরণ (স্পেসিফিকেশন) আবশ্যক।

পজেটিভকে নেগেটিভ বলা, নেগেটিভকে পজেটিভ বলার সুযোগ প্রথমেই শেষ করে দিতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যেহেতু এই গবেষণায় মানবদেহের স্যাম্পল ব্যবহৃত হবে, তাই যে কোনো একটা রিসার্চ এথিক্স কমিটির অনুমতি নিতে হবে। মহামারির মধ্যে এই অনুমতি একদিনে পাবার ব্যবস্থা করা সম্ভব। সেটা বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি) বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ এথিক্স কমিটিই দিতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মার্চ মাস থেকে বলে আসছে, টেস্ট, টেস্ট এবং টেস্ট। সম্ভাব্য আক্রান্তদের টেস্ট করে আলাদা করে ফেলতে পারলেই করোনার বিস্তার রোধ করা সম্ভব। তাই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র আবিষ্কৃত কিটটি কার্যকর কিনা তা প্রমাণিত হওয়া দরকার। এজন্য অবশ্যই ড. বিজন কুমার শীলসহ বিজ্ঞানীদের আরেক ধাপ গবেষণায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। আমরা চাই জাতির সঙ্গে রসিকতা না করে প্রকৃত ও কার্যকর কিট চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হোক। যা আমাদের করোনা প্রাদুর্ভাবকে নিয়ন্ত্রণ করতে ভূমিকা রাখবে।

২৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঁচ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করে বিশ্বের সকল নেতা, সংস্থা ও ফোরামের ঐক্যের মাধ্যমে একসঙ্গে করোনা যুদ্ধে জয়ী হওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন।

দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় আ লিক সহযোগিতা জোরদার বিষয়ক ওই তারিখের ভার্চুয়াল সম্মেলনে তিনি আরো বলেন, ‘বিশ্ব সম্ভবত গত ১০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় সংকটের মুখোমুখি। সুতরাং সবাই একসঙ্গে সংকটের মোকাবিলা করা দরকার। সমাজের প্রতিটি পর্যায় থেকে সমন্বিত দায়িত্বশীলতা এবং অংশীদারিত্বমূলক মনোভাব প্রয়োজন।’

অর্থাৎ সমাজের বিজ্ঞানী ও গবেষকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা জাতিকে রক্ষা করতে পারে। আক্রান্ত মানুষকে বাঁচানোর জন্য এক্ষেত্রে সততা ও নিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। জাফরুল্লাহ চৌধুরী মিথ্যাচার না করে জাতিকে সঠিক নির্দেশনা দিবেন বলে আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: মিল্টন বিশ্বাস- অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্রঃ মানবকণ্ঠ

আলোকিত রাঙামাটি

সর্বশেষ