রাঙামাটি । শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ , ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কাপ্তাই প্রতিনিধিঃ-

প্রকাশিত: ১১:৪৪, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২১

নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বিলাইছড়ির ‘গাছকাটা ছড়া ঝর্ণা’

নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বিলাইছড়ির ‘গাছকাটা ছড়া ঝর্ণা’

মোঃ নজরুল ইসলাম লাভলু, কাপ্তাইঃ- চাকমা ভাষায় গাছকাবা ছড়া ঝর্ণা, তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় গাছ ছোঁয়া ছড়া ঝর্ণা আর অনেকেই চিনে গাছকাটা ছড়া ঝর্ণা নামে। যে যেই নামেই চিনুক না কেন, প্রকৃতি তার আপন মাধুরী দিয়েই সাঁজিয়েছে এই ঝর্ণাকে। পাহাড়ের প্রায় ১শ' ২০ ফুট উঁচু হতে অবিরাম ধারায় যে জলের স্রোতধারা প্রবাহিত হচ্ছে, তা যেন নিছক জলের শব্দ নয়, বরং সুর আর ছন্দের তালে যেনো বেজে আসছে কোন স্বর্গপরীর অপূর্ব সুরধ্বনি। যে সুরের ধ্বনিতে হৃদয়ের প্রতিটি অন্তরালে জাগে নব শিহরণ। মনকে নিয়ে যায় অনন্তের যাত্রা পথে। যেখানে পৌঁছালেই পাওয়া যায় অনাবিল আনন্দ। 

নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলা নিকেতন ঐতিহ্যবাহী রাঙামাটি জেলার অপূর্ব সৌন্দর্য মণ্ডিত বিলাইছড়ি  উপজেলা। কাপ্তাই হ্রদের কোলে শুয়ে আছে এই উপজেলা। বিলাইছড়ি উপজেলার প্রতিটি পরতে পরতে লুকিয়ে আছে অপরুপ সৌন্দর্য। অনেকগুলো ছোট বড় পাহাড় আর ঝর্নায় সমৃদ্ধ এই উপজেলা। যেদিকেই চোখ যায় সেদিকেই যেনো অনন্ত সবুজের সমারোহ। 

এই বিলাইছড়ি উপজেলার ১নং সদর ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের দোজোড়ী পাড়ায় এই গাছকাটা ছড়া ঝর্ণা অবস্থিত। চাকমা ভাষায় দোজোড়ী হলো দুইটি ছড়ার সমাহার। এই দুটি ছড়ার মাঝখানে পাহাড়ের চুড়ায় এই ঝর্ণা অবস্থিত। বর্ষা কাল ছাড়াও বছরের প্রায় সময় এই ঝর্ণা হতে ঝিরিঝিরি শব্দ ও স্বচ্ছ জল প্রবাহ বয়ে যায়। যে জলের প্রবাহমান ধারা মিশে গেছে কাপ্তাই হ্রদে।

তবে কি, এটি গাছকাবা ছড়া ঝর্ণা বা গাছকাটা ছড়া ঝর্ণা নামেই এই ধরণীতে তার আপন রূপ, সৌন্দর্য আর মাধুরীতে বেঁচে আছে যুগ যুগ ধরে। এর নামকরণ নিয়েও রয়েছে নানা কিংবদন্তি।

স্থানীয় গাছকাবা ছড়া ভিসিএফ কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুশীল বিকাশ চাকমা জানান, স্থানীয় ভাবে প্রচলিত একটি ইতিহাসের কথা। সে ইতিহাসের পাতায় পাতায় আছে বেদনা আর পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর দুঃখের গল্প।

তিনি জানান, তার দাদুর মুখ হতে শুনা ইতিহাসের করুণ কাহিনী। শত বছর বা তারও আগে এই ঝর্ণার উপরে মাছ ধরতে যায় দ্বন্ধ তঞ্চগ্যা এবং তার স্ত্রী (যদিও তার স্ত্রীর নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি)। মাছ ধরতে গিয়ে হঠাৎ পানির প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় ওই সময় তারা পাহাড়ের চুড়া হতে পড়ে মারা যায়। এই দ্বন্ধের নামকরণে স্থানীয়রা এই ঝর্ণাকে "দ্বন্ধ পচ্চে তারেং ঝর্না" নামে ডাকে। পরবর্তীতে এটি গাছকাবা ছড়া বা গাছকাটা ছড়া ঝর্ণা নামে পরিচিতি লাভ করে। 

এই ঝর্ণার সৌন্দর্য উপভোগ করার আগে দৃষ্টিনন্দন পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর জীবন ধারা, অনেক গুলো ছড়া, ছোট ছোট পাহাড় আর সবুজের সমারোহ পেরিয়ে পৌঁছাতে হয় এই ঝর্ণায়। পথিমধ্যে গাছকাটা ছড়া পাড়া, গোলকধন পাড়া আর দোজোড়ী পাড়া পার হয়ে মূল ঝর্ণার আগে দেখা মিলবে আরো একটি ঝর্ণা। চাকমা ভাষায় যাকে "সাদারা" বা পাথরের ঝর্ণা বলে। ৩শ' ফুট উপর হতে এই ঝর্ণার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। হিমশীতল এই ঝর্ণায় ভিজে যে কেউ তার মনকে পবিত্রতায় ভরে তুলতে পারে।

আলাপ হয় এই দোজড়ী পাড়ার কার্বারি গোপাল চন্দ্র চাকমার সাথে। তিনি জানান, এই পাড়ায় ৪৮ পরিবারের বসবাস। তাদের মধ্যে চাকমা ২৬ পরিবার, তঞ্চঙ্গ্যা ১৯ পরিবার এবং মারমা ৩ পরিবার। জনসংখ্যা ২শ' ২১ জন। অধিকাংশ পরিবার কৃষি এবং জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। তবে এই এলাকায় রাস্তাঘাট সহ অবকাঠামো উন্নয়ণ করলে এখানে পর্যটকের আগমন বাড়বে এবং এলাকার উন্নতি হবে।

একই কথা বললেন, সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি দেওয়ান ও ৩নং কুতুবদিয়া ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জয়তন তনচংগ্যা। তারা এই এলাকার উন্নয়নে পর্যটন কর্পোরেশন এবং সরকারের নিকট আকুল আবেদন জানান। যাতে এই এলাকায় পরিবেশের সামগ্রিক ভারসাম্য বজায় রেখে রাস্তাঘাট উন্নয়ন করা হয়।

ঝর্ণা দেখতে আসা বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) জাবেদ আহমেদ বলেন, অসম্ভব সুন্দর একটি ঝর্ণা গাছকাটা ছড়া ঝর্ণা। তারা এখনও এই ঝর্ণা পর্যটকদের সামনে তুলে ধরতে পারেনি। তবে এই ঝর্ণাকে তারা বিশ্বের কাছে পরিচিত করতে চায়। যার ফলে এখানে বিশ্বের এ্যাডভেঞ্চার প্রিয় লোকজন আসবে।

তিনি আরো জানান, এই পথটা বন্ধুর, তাই তারা এখানকার রাস্তাঘাট, অবকাঠামো উন্নয়ন করতে চায় এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সাথে নিয়েই এই ঝর্ণাগুলো আরো সুপরিচিতি করতে চায়, যাতে এই এলাকার মানুষের আত্ম-সামাজিক উন্নয়ন ঘটে।

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের উপ-পরিচালক সাইফুল হাসান বলেন, তারা পর্যটকদের জন্য নতুন নতুন গন্তব্য স্থান চিহ্নিত করার জন্য এই এলাকায় এসেছেন। পর্যটকদের এসব স্থানে আগমনের জন্য তারা প্রমোশন এবং উদ্বুদ্ধকরণের কাজ করে থাকেন। যার ফলে দেশ বিদেশের অনেক পর্যটক আসবে। কমিউনিটি বেইজড ট্যুুরিজমের মাধ্যমে তারা এই এলাকার স্থানীয় জনগণের আয় বৃদ্ধি কিভাবে করা যায় সে বিষয়ে কাজ করছেন।

বিলাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মিজানুর রহমান জানান, এই উপজেলায় অবস্থিত গাছকাটা ছড়া ঝর্ণা এখানকার অনিন্দ্য সুন্দর ঝর্ণার মধ্যে অন্যতম। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সবুজের সমারোহে এই ঝর্ণায় এসে যে কেউ মুগ্ধ হবেন। এখানকার ঝর্ণা গুলোর উন্নয়ন করে তারা এই এলাকার স্থানীয় জনগণের জীবনমান উন্নয়ন ঘটাবেন।

বিলাইছড়ি উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান উৎপলা চাকমা জানান, এই উপজেলায় কাপ্তাই লেকের পাশাপাশি পাহাড়, ছড়া আর ঝর্ণা রয়েছে। তাই এখানে যদি পর্যটন উপযোগী পরিবেশ এবং উন্নয়ন করা যায় তাহলে এই এলাকার উন্নয়ন ঘটবে।

ঝর্ণা দেখতে আসা পর্যটকরা তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, এই ঝর্ণা দেখতে সুন্দর, এই ঝর্ণা দেখতে পেরে তারা অনেক আনন্দিত।

রাঙামাটি জেলা বা কাপ্তাই উপজেলা হতে নৌ পথে কাপ্তাই হ্রদ পথে ইঞ্জিন চালিত বোটে প্রায় ২ ঘন্টা সময় ধরে যাওয়ার পর বিলাইছড়ি গাছকাটা ছড়া সেনা ক্যাম্পের ডান পাশ দিয়ে প্রথমে পৌঁছাতে হবে গাছকাটা ছড়া পাড়ায়। এরপর ওই স্থান হতে পাঁয়ে হেঁটে ছোট ছোট পাহাড়, ছড়া,পাহাড়ী মেঠোপথ, সবুজের ক্ষেত পার হয়ে দোজোড়ী পাড়ায় যেতে হয়। এই পাড়ায় দুই ছড়ার মাঝখানে পাহাড়ের চুড়ায় এই ঝর্ণা অবস্থিত। তবে কাপ্তাই হ্রদের পাড় হতে ঝর্ণায় আসার প্রায় ৪ কিঃ মিঃ পথই চলাচলের অনুপযোগী।

তবে অনেকেই আগের দিন এসে বিলাইছড়ি উপজেলায় রাত্রি যাপন করে পরের দিন সকালে এই ঝর্ণা দেখতে যায়। বিলাইছড়ি উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ২০১৯ সালে পাহাড়ের টিলাতে নির্মাণ করা হয়েছে "নীলাদ্রি রিসোর্ট"। এই রিসোর্টে ৪টি সুন্দর কটেজ রয়েছে। কটেজ সংলগ্ন উপজেলা ক্যাফেতে উন্নত মানের খাবারের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।

আলোকিত রাঙামাটি

সর্বশেষ