রাঙামাটি । বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ , ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকাশিত: ১৩:১৫, ৬ ডিসেম্বর ২০২২

আপডেট: ১৪:০৩, ৬ ডিসেম্বর ২০২২

কাপ্তাইয়ের ওয়াগ্গাছড়ায় বধ্যভূমি চিহ্নিত করার দাবী শহীদ পরিবারের

কাপ্তাইয়ের ওয়াগ্গাছড়ায় বধ্যভূমি চিহ্নিত করার দাবী শহীদ পরিবারের
গণহত্যার এলাকা পরিদর্শন করেন কাপ্তাই ইউএনও এবং সে সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী গৌরাঙ্গ মোহন বিশ্বাস হাত দিয়ে জায়গাটা দেখিয়ে দিচ্ছেন।

কাপ্তাইয়ের ওয়াগ্গাছড়ায় বধ্যভূমি চিহ্নিত করার দাবী করেছে উপজেলার কয়েকজন শহীদ পরিবারের সদস্য। ৭১ এর যুদ্ধকালীন সময় সহস্রধিক বাঙালীকে চন্দ্রঘোনা, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকা হতে ধরে এনে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের এদেশীয় দোসররা গুলি করে হত্যা করেছিল। দাবী করেন শহীদ পরিবারের সদস্য কাপ্তাই উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি রাইখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা দীপক ভট্টাচার্য, মিলন কান্তি দে ও সে সময়ের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ওয়াগ্গাছড়ার বাসিন্দা গৌরাঙ্গ মোহন বিশ্বাস।

তাদের কাছ থেকে গণহত্যায় শহীদ এবং আহত কিছু লোকের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন- শহীদ নলিনী রঞ্জন দে, শহীদ নিকুঞ্জ বিহারী দে, শহীদ রায় মোহন ঘোষ, শহীদ পরান ভট্টাচার্য, শহীদ বিজয় ভট্টাচার্য, শহীদ রেবতি ভট্টাচার্য, শহীদ সুর্য্য চন্দ্র দে এবং শহীদ পাইসু মারমা।

এরা সকলেই কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা। এছাড়া সুনীল কান্তি দে নামে রাইখালী ইউনিয়নের একব্যক্তি গুরুতর আহত হয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন বলে শহীদ পরিবারের ওই সদস্যরা জানান। তবে প্রায় ৮ বছর আগে তিনি মারা যায়।

প্রত্যক্ষদর্শী গৌরাঙ্গ মোহন বিশ্বাস জানান, যুদ্ধকালীন সময় তার বয়স ছিল ১৫ বছর। তার বাবা ক্ষিরোদ চন্দ বিশ্বাস চাকরি করতেন তৎকালীন রুহিনী মহাজনের মালিকানাধীন ওয়াগ্গা চা বাগানে। তাদের বসতবাড়ি ছিল বর্তমানে যেখানে ৪১ বিজিবি ক্যাম্প রয়েছে সেখানে। যুদ্ধকালীন সময় ওয়াগ্গাছড়ায় একটি পাকবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। সে সময় পাকবাহিনী বিভিন্ন জায়গা থেকে বাঙালীদের ধরে এনে ক্যাম্পের পাশে ওয়াগ্গাছড়া খালের পাশে সারিবদ্ধভাবে গুলি করে লাথি মেরে খালে ফেলে দিত। আবার কিছুকিছু লোককে ক্যাম্পের পাশে একটা পাহাড়ের খাদে নিয়ে প্রথমে তাদেরকে দিয়ে গর্ত খুঁড়িয়ে গুলি করে সেই গর্তেই পুঁতে ফেলা হতো।

তিনি আরও জানান, ৭১ এর এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় পাকবাহিনী এখানে ক্যাম্প করে এই গণহত্যা শুরু করে। তারা দেশ স্বাধীন হবার আগ পর্যন্ত প্রায় সহস্রাধিক বাঙালীকে এখানে হত্যা করে। 

সে সময়ের ওয়াগ্গাছড়া গণহত্যার অন্যতম সাক্ষী ওয়াগ্গাছড়ার বাসিন্দা ১শ’ ৮ বছর বয়সী সহদেব দে।

অসুস্থতা এবং বয়সের ভারে স্মৃতিশক্তি লোপ পেলেও তিনি জানান, আমি তখন ওয়াগ্গা চা বাগানে কাজ করতাম। পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী বিভিন্ন জায়গা থেকে বাঙ্গালীদের ধরে এনে এই ওয়াগ্গাছড়া খালের পাশে গুলি করে হত্যা করতো।  

শহীদ নলিনী রঞ্জন দে’র ছেলে রাইখালীর বাসিন্দা মিলন কান্তি দে এবং শহীদ রেবতি ভট্টাচার্যের ভাইয়ের ছেলে দীপক কুমার ভট্টাচার্য জানান, ১৯৭১ সালে রাইখালী বাজারের বেশ কিছু বাসিন্দা কাপ্তাই সড়কের মদুনাঘাট এলাকায় যুদ্ধরত তৎকালীন ইপিআর সদস্যদের বন্ধুক ও খাওয়ার রসদ যোগাতেন। পাকিস্তানি সৈন্য এবং রাজাকার বাহিনী এই খবর জানতে পেরে ৭১ এর ২৯ এপ্রিল সকালে রাইখালী বাজার থেকে ৯ জনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে মারতে মারতে ওয়াগ্গাছড়া পাক বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে আসে এবং তাদের গুলি করে। তাদের মধ্যে ৭ জন সাথে সাথে মারা যান। তবে সুনীল কান্তি দে সেদিন সন্ধ্যায় আহত অবস্থায় পালিয়ে আসে। এছাড়া গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ৩ দিন পর নিকুঞ্জ বিহারী দে’ কে আহত অবস্থায় সে সময়ে নৌকার ছিদ্দিক মাঝি বড়ইছড়ি ঘাট দিয়ে রাইখালীতে পার করে দেয়। এজন্য পাক বাহিনী ছিদ্দিক মাঝিকেও নির্যাতন করে বলে তারা জানায়। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হবার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে চন্দ্রঘোনা মিশন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নিকুঞ্জ বিহারী দে’কে হেলিকপ্টার যোগে ঢাকা পিজি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। 

এই শহীদ পরিবারের সদস্যরা ওয়াগ্গাছড়া এলাকায় একটি বধ্যভূমি চিহ্নিত করে স্মৃতি চিহ্ন নির্মাণ এবং রাইখালী এলাকায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে সোমবার একটি দাবিনামা উপস্থাপন করেন।

কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনতাসির জাহান জানান, গত সোমবার শহীদ পরিবারের সন্তানরা ওয়াগ্গাছড়াকে বধ্যভূমি চিহ্নিত করার দাবিতে একটা চিঠি দেয়। সাথে সাথে আমি ওইদিন (৫ নভেম্বর) কাপ্তাই উপজেলার ৫নং ওয়াগ্গা ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের ৪১ বিজিবি ক্যাম্পের বিপরীত রাস্তা দিয়ে প্রায় ২শ’ মিটার পথ পাড়ি দিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে ওয়াগ্গাছড়া খালের জায়গাটির পাশের ওয়াগ্গাছড়ায় পৌঁছায়। এ সময় উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা রুহুল আমিন, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা নাজমুল হাসান, ওয়াগ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান চিরনজীত তনচংগ্যা, ইউপি সদস্য অমল কান্তি দে, কাপ্তাই প্রেস ক্লাব সাধারণ সম্পাদক ঝুলন দত্তসহ শহীদ পরিবারের সদস্যরা সাথে ছিল। বিষয়টি আগে কেউ আমাকে অবগত করেনি। তবে স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী এবং গণ্যমান্য মুরুব্বীদের সাথে কথা বলে এই এলাকায় একটা স্মৃতি চিহ্ন করা যায় কিনা সে বিষয়ে আমার প্রচেষ্টা থাকবে। 

ওয়াগ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ওয়াগ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি চিরনজীত তনচংগ্যা এবং সাধারণ সম্পাদক ইউপি সদস্য অমল কান্তি দে’ এই এলাকায় একটি বধ্যভূমির স্মৃতি চিহ্ন করার দাবি জানান।

জনপ্রিয়