রাঙামাটি । বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ , ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকাশিত: ১১:৪১, ১১ আগস্ট ২০২১

নতুন হিজরি বর্ষের বার্তা

নতুন হিজরি বর্ষের বার্তা

ফাইল ছবি


আজ হিজরি নববর্ষ। হিজরি বছরের প্রথম মাস মহররম শুরু হলো আজ। আজ পহেলা মহাররম। ইসলামী বর্ষ পঞ্জির প্রথম মাসের পথম দিন। ১৪৪২ হিজরি সনকে বিদায় জানিয়ে শুরু হলো ১৪৪৩ হিজরি বর্ষের পথচলা। ইসলামে এদিনটি মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য এক বিশেষ স্মারক। হিজরি সন এমন একটি সন, যার সঙ্গে মুসলিম উম্মাহর তাহজিব-তামাদ্দুন ও ঐতিহ্যের ভিত্তি সম্পৃক্ত।

মুসলমানদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও আনন্দ-উৎসবসহ সব ক্ষেত্রেই হিজরি সনের অনুসারী। বিশেষত রোজা, হজ, ঈদ, শবেবরাত, শবে কদরসহ ইসলামের বিভিন্ন বিধি-বিধান হিজরি সনের ওপর নির্ভরশীল। ইসলামি আরবি বর্ষপঞ্জিকার সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রিয় নবীজির হিজরতের স্মৃতি, তাই যুগ যুগ ধরে মুসলমানদের কাছে হিজরি সাল একসময় বেশ গুরুত্বপূর্ণ হলেও আজকাল তা কেবল রমজান ও ঈদের হিসাব রাখার মধ্যে সীমিত হয়ে আছে।

হিজরি সনের গুরুত্ব
বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর কৃষ্টি-কালচারে হিজরি সনের গুরুত্ব অপরিসীম। হিজরি সন গণনার সূচনা হয়েছিল ঐতিহাসিক এক অবিস্মরণীয় ঘটনাকে উপলক্ষ করে। রাসূল (সা.) এবং তার সঙ্গী-সাথীবর্গের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই আরবি মহররম মাসকে হিজরি সনের প্রথম মাস ধরে সাল গণনা শুরু হয়েছিল। আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে তথা দ্বীনের স্বার্থে পবিত্র মক্কা থেকে মদিনায় রাসূল (সা.) এবং সাহাবায়ে কেরামগণের হিজরতের বছর থেকেই হিজরি সনের সূচনা।

ইতিহাসে আলোকে হিজরি সন
হিজরি সন হল মুসলিমদের সন। ৬২২ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই সেপ্টেম্বর আল্লাহর নির্দেশে মুহাম্মদ (সা.) মক্কা হতে মদীনায় হিজরত করেন। মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ৬২২ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ বা ১৫ জুলাইয়ের সূর্যাস্তের সময়কে হিজরি সন শুরুর সময় হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। হিজরি সন ১৭ হিজরি সাল (৬৩৮ খ্রীষ্টাব্দ) হতে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের শাসক হযরত ওমর (রা.) – এর শাসন আমলে হিজরি সন গণনা শুরু হয়।

হজরত ওমর (রা.) এর কাছে ইরাক ও কুফার প্রশাসক আবু মুসা আশ‘আরী (রা.) এক চিঠিতে লেখেন, 'বিশ্বাসীদের নেতা আপনার পক্ষ হতে আসা শাসন কার্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উপদেশ, পরামর্শ এবং নির্দেশ সম্বলিত বিভিন্ন চিঠিপত্র ও দলিলে কোন সন-তারিখ না থাকায় আমরা তার সময় ও কাল নির্ধারণে যথেষ্ট সমস্যার সম্মুখীন হই। অধিকাংশ সময় এসব নির্দেশনার সঙ্গে পার্থক্য করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে বলে আপনার নির্দেশ ও উপদেশ পালন করতে যেয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে।' এ গুরুত্বপূর্ণ পত্র পাওয়ার পর হজরত ওমর (রা.) মুসলিম বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে এক পরামর্শ সভার আয়োজন করেন। পরামর্শ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে রাসূল (সা.)- এর মদীনায় হিজরত করার ঐতিহাসিক দিন থেকে নতুন একটি সন তৈরী করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

হিজরতের ঘটনাকে স্মরণ করে হিজরি সন শুরু করার কারণ হলো, রাসূল (সা.)- এর মদীনায় হিজরত করার মাধ্যমে ইসলাম প্রসার লাভ করে, মুসলিমদের সংখ্যা বাড়তে থাকে, মুসলিমদের শক্তিমত্তা বাড়তে থাকে, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, ইসলাম বিজয়ী শক্তিতে পরিণত হয় এবং ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়। তাছাড়া আল্লাহ তায়ালা রাসূল (সা.) এর হিজরতের কথা গুরুত্বের সঙ্গে কোরআনে উল্লেখ করেছেন। হিজরতের ঘটনাকে স্মরণ করে বানানো হয়েছে বলে এ সনকে হিজরি সন বলা হয়।

বাংলাদেশে হিজরি সন
ইসলাম প্রচারের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশে হিজরি সনের প্রচলন ঘটেছে। বাংলাদেশে ১২০৪ খ্রীষ্টাব্দ হতে সর্বক্ষেত্রে হিজরি সন ব্যবহার শুরু হয় (তবাকাতে নাসিরী)। উপমহাদেশে প্রায় ৫৫০ বৎসর রাষ্ট্রীয়ভাবে এই হিজরি সন স্বীকৃত ছিল।

হিজরি সনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য
হজরত ওমর (রা.) তার খেলাফতকালের চতুর্থ বছর (৬৩৮ খ্রীষ্টাব্দ) হতে হিজরি বর্ষ পদ্ধতিগত গণনার ভিত্তিতে প্রসার ও প্রচলন শুরু করেন। এ সময থেকেই ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং আদর্শগত ঐতিহ্যের প্রেক্ষিতে মুসলিমরা মুহাররম মাস দ্বারা বর্ষ গণনা শুরু করেন। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ও ধর্মীয় চিন্তা-চেতনায় হিজরি সনের প্রভাব সর্বাধিক। এতদসত্ত্বেও দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, আমরা অনেকেই অবগত নই যে, মুহাররম মাস ইসলামী নববর্ষ -আনন্দের দিন। কেননা ইসলামের ঘটনাবহুল ইতিহাসের একটি অতি তাৎপর্যমন্ডিত ঘটনাকে স্মরণীয রাখার দিনটি হচ্ছে মুহাররম মাস। বিশ্বের মুসলিমদের কাছে ইসলামী সন হিসেবে হিজরি সন অতি পবিত্র ও অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ।

শুধুমাত্র এই একটি সালেই সমগ্র বিশ্বে সর্বত্র সমানভাবে সমাদৃত। মুসলিমদের কাছে হিজরি সন বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত সন। আল্লাহ তার রাসূল (সা.) কে নবুওয়াত দান করলেন। তিনি ইসলামের দাওয়াত দেওয়া শুরু করলেন। তখন থেকেই রাসূল (সা.) এর একান্ত আপন জনেরা দূরে সরে যেতে লাগল। সবাই তার বিরোধীতা করতে লাগল। অল্প কিছু লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করল। গোপনে গোপনে তিন বছর দাওয়াত দিলেন। এর পর আল্লাহর নির্দেশে সাফা পাহাড়ে প্রাকশ্যে এক আল্লাহর উপর ঈমান আনয়নের ঘোষণা করে ছিলেন। তখন থেকেই আরম্ভ হলো নির্যাতন। পথে-প্রান্তে তাকে অপমানিত, লাঞ্ছিত করা হতো। নামাজরত অবস্থায় উটের নাড়ী-ভুড়ি তার পিঠের উপর চাপিয়ে দেয়া হতো।

গমনা-গমনের পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখা হতো। শিয়াবে আবু তালিব নামক স্থানে দীর্ঘদিন বন্দী করে রাখা হলো। এরপর তার সাহাবীদের উপর অমানুষিক নির্যাতন করা হলো। কাফেররা নবীজীকে শারীরিক নির্যাতন করে দাওয়াত থেকে বিরত করতে পারল না। তখন তারা মানুষিক নির্যাতন করার জন্য নানা রকম ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে লাগল। তারা তাকে পাগল, কবি, জাদুকর ইত্যাদি বলে অপপ্রচার করতে থাকলো। কিন্তু কিছুতেই কোন কাজ হলো না। একদিন তারা ‘দারুন নদওয়া’ নামক তাদের মন্ত্রণাগৃহে একটি বৈঠক করলো। সেখানে তারা সিদ্ধান্ত নিল মুহাম্মদ -কে দুনিয়া হতে সরিয়ে দেওয়ার। সবাই এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করলো।

মক্কার শক্তিশালী লোকেরা একত্রিত হয়ে শপথ নিয়ে বের হলো। মুহাম্মদ (সা.) এর বাড়ি ঘেরাও করে তাকে হত্যা করবে।( নাউযুবিল্লাহ!!) আল্লাহ তায়ালা ইসলাম প্রচারের সুবিধা ও মুসলিমদের কথা ভেবে মক্কা থেকে মদীনায় দেশান্তরিত হবার আদেশ দেন। এই দেশান্তরিত হওয়াকেই আরবিতে হিযরত বলে। সে দিন ছিল ১২ই সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রীষ্টাব্দ। আল্লাহর এই ঘোষণা পাওয়ার পর রাতের অন্ধকারে নিজ বিছানায় হজরত আলী (রা.) কে রেখে মদীনার পথে রওয়ানা দিলেন। পরবর্তিতে এই ঐতিহাসিক দিনটিকে হজরত ওমর (রা.) তারিখ গণনা করার জন্য নির্ধারণ করেন।

নতুন বছরে আমাদের শিক্ষা 
সকাল যায় দুপুর আসে আর বিকাল যায় রাত পোহাই। শৈশব, কৈশোর, প্রথম যৌবন, মধ্য যৌবন, পরিণত যৌবন এবং আজকে এই পড়ন্তবেলায় দাঁড়িয়ে আশিবছরের বৃদ্ধ দাদা যখন অতীত নিয়ে ভাবেন তখন তার প্রকাশ্য জীবনের আলো -অন্ধকার অতীত নিয়ে তিনিই ভালো জানেন। কী করে তিনি দিনাতিপাত করেছেন। সুন্দর জীবন কার? এই বিষয়ে জীবন বিশেষজ্ঞ নবী (সা.) -কে প্রশ্ন করা হলে উত্তরে তিনি বলেন, 'যার হায়াত দীর্ঘ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমল কর্মজীবনও ভালো হবে সেই উত্তম ব্যক্তি।' অর্থাৎ শরীয়ত সম্মত জীবনাচারে জীবনকে অতিবাহিত করা।

গতবছর আমার কেমন গেলো তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা। আমি কি ভালো কাজ করে মূল্যবান সময় অতিবাহিত করেছি, না আজে-বাজে কাজে, গল্প-গুজব আর অযথা সময় নষ্ট করে সময় কাটিয়েছি?

প্রসিদ্ধ সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, 'আমার সবচে আফসোস ও পরিতাপ হয় এমন দিনের জন্য, যেদিনের সূর্য ডুবে গেল, অথচ সেদিনে আমার নেক আমল বৃদ্ধি পেল না।' তাবেয়ী হাসান বসরী রহ. বলেন, 'হে আদম সন্তান! তুমি তো ক’দিনের সমষ্টি মাত্র। সুতরাং যখন একটি দিন অতিবাহিত হয়ে গেল তখন তোমার জীবনের একাংশ হারিয়ে গেল।' তিনি আরো বলেন, 'আমি এমন অনেক ব্যক্তির সাহচর্য পেয়েছি, সময় সংরক্ষণে যাদের আগ্রহ, তোমাদের ধন- সম্পদ সংরক্ষণের আগ্রহের চেয়ে বেশি ছিল।'

আসুন, তাওবা ও ইস্তিগফারের মাধ্যমে পুরোনো বছরকে বিদায় দিয়ে ইবাদতের মাধ্যমে নতুন বছরকে স্বাগত জানাই। বিশ্বাস, আশা ও ভালোবাসা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাই। জীবনের অনন্ত যাত্রায় একে অন্যের সহযোগী ও কল্যাণকামী হই। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন বছরকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে বেশি বেশি নেক আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

আলোকিত রাঙামাটি

জনপ্রিয়