রাঙামাটি । বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ , ১৩ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১৩:১৪, ১০ নভেম্বর ২০২১

পরম সম্প্রীতির শিক্ষা দেয় ইসলাম

পরম সম্প্রীতির শিক্ষা দেয় ইসলাম

পরম সম্প্রীতির শিক্ষা দেয় ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত


ইসলাম হলো চির শান্তি ও পরম কল্যাণধর্মী এক জীবন ব্যবস্থার নাম। এটি এমন এক শান্তিময় জীবনব্যবস্থা, যেখানে স্ববিস্তার আলোচনার মাধ্যমে মানব জাতির সবারই অধিকার প্রদান করা হয়েছে। সব মানুষই এক আল্লাহর সৃষ্টি এবং একই জাতির।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সব মানুষ ছিল একই জাতিভুক্ত। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা পয়গম্বর পাঠালেন সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী হিসেবে।’ (সুরা বাকারা : ২১৩)। তাই সৃষ্টিগতভাবে সমগ্র মানবগোষ্ঠী বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ। এ ভ্রাতৃত্ব বিশ্ব মানবতার মৌলিক ভ্রাতৃত্ব।

মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মানব মণ্ডলী! আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদের বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার।’ (সুরা হুজুরাত : ১৩)। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সব মানুষই আদম (আ.)-এর বংশধর, আর আদম মাটি থেকে সৃষ্ট।’ (তিরমিজি)।

প্রকৃতপক্ষে, সব মানুষই হযরত আদম ও হাওয়া (আ.)-এর সন্তান। এ হিসেবে সব মানুষ একই বংশের ও পরস্পর ভাই ভাই। হযরত মুহাম্মদ (সা.) আরও বলেছেন, ‘সমগ্র সৃষ্টিই আল্লাহর পরিজন।’ (বায়হাকি)

বিশ্বমানবতার শান্তি প্রতিষ্ঠায় মহান আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসুল (আ.) পাঠিয়েছিলেন এবং তারা সবাই মানবতার বাণী প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বলুন, হে মানব মণ্ডলী! তোমাদের সবার প্রতি আমি রাসুল হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।’ (সুরা আরাফ : ১৫৮)। নবী-রাসুলগণের শিক্ষা ও আদর্শ নির্দিষ্ট কোনো জাতি-গোষ্ঠী ও সময়ের জন্য নয়, বরং সবার জন্য সর্বকালেই তা অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা বলে, আমরা তাঁর রাসুলদের মাঝে কোনো পার্থক্য করি না।’ (সুরা বাকারা : ২৮৫)

যার যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে এটাই ইসলামের শিক্ষা। কেননা একই আদম হাওয়া থেকে আমাদের সবার উদ্ভব। কে কোনো ধর্মের অনুসারী তা মূল বিষয় নয়, বিষয় হলো আমরা সবাই মানুষ। মানুষ হিসেবে আমরা সবাই এক জাতি। এক জোড়া পুরুষ-নারী থেকে সৃষ্ট মানবমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে সবারই আল্লাহ তায়ালার সামনে সমমর্যাদার অধিকারী। চামড়ার রং, ধন-সম্পদের পরিমাণ, সামাজিক মর্যাদা, বংশ ইত্যাদির দ্বারা মানুষের মর্যাদার মূল্যায়ন হতে পারে না।

মর্যাদা ও সম্মানের সঠিক মাপকাঠি হলো ব্যক্তির উচ্চমানের নৈতিক গুণাবলী এবং স্রষ্টা ও সৃষ্টির প্রতি তার কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে আন্তরিকতা। বিশ্ব মানব একটি পরিবার বিশেষ। জাতি, উপজাতি, বর্ণ, বংশ ইত্যাদির বিভক্তি কেবল পরস্পরকে জানার জন্য, যাতে পরস্পরের চারিত্রিক ও মানসিক গুণাবলী দ্বারা একে অপরের উপকার সাধিত হতে পারে।

মহানবীর (সা.) মৃত্যুর অল্পদিন আগে বিদায় হজের সময় বিরাট ইসলামি সমাগমকে সম্বোধন করে তিনি (সা.) উদাত্ত কন্ঠে বলেছিলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং তোমাদের আদি পিতাও এক। একজন আরব একজন অনারব থেকে কোনো মতেই শ্রেষ্ঠ নয়। তেমনি একজন আরবের ওপরে একজন অনারবেরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই।'

একজন সাদা চামড়ার মানুষ একজন কালো চামড়ার মানুষের চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়, কালোও সাদার চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়। শ্রেষ্ঠত্বের মূল্যায়ন করতে বিচার্য বিষয় হবে, কে আল্লাহ ও বান্দার হক কতদূর আদায় করলো। এর দ্বারা আল্লাহর দৃষ্টিতে তোমাদের মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী সেই ব্যক্তি, যিনি সর্বাপেক্ষা বেশি ধর্মপরায়ণ’ (বায়হাকি)।

এই মহান শব্দগুলো ইসলামের উচ্চতম আদর্শ ও শ্রেষ্ঠতম নীতি-মালার একটি দিক উজ্জলভাবে চিত্রায়িত করেছে।

শতধা-বিভক্ত একটি সমাজকে অত্যাধুনিক গণতন্ত্রের সমতা-ভিত্তিক সমাজে ঐক্যবদ্ধ করার কী অসাধারণ উদাত্ত আহবান। ধর্ম নিয়ে যারা আজ অতি বাড়াবাড়ি করছে তাদের কাছে জানতে চাই, ধর্ম কি নৈরাজ্য সৃষ্টির নাম, ধর্মের নাম কি রক্তপাত? মোটেও তা নয়, ধর্ম শান্তির নাম।

ইসলাম সব ধর্মের উপাসনালয়কে শ্রদ্ধা ও সম্মানের দৃষ্টিতে দেখারও নির্দেশ দিয়েছে এবং কারো উপাসনালয়ে হামলা চালানোকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। শুধু তা-ই নয় বরং অমুসলিমরা যেসবের উপাসনা করে সেগুলোকে গালমন্দ করতেও আল্লাহপাক বারণ করেছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেছেন- ‘আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারা যাদের উপাস্যরূপে ডাকে তোমরা তাদের গালমন্দ করো না। নতুবা তারা শত্রুতাবশত না জেনে আল্লাহকেই গালমন্দ করবে’ (সুরা আন আম: ১০৮)। এ আয়াতে শুধু প্রতিমা পূজারীদের সংবেদনশীলতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য নির্দেশ দান করা হয়নি বরং সব জাতি এবং সব সম্প্রদায়ের মাঝে বন্ধুত্ব এবং সৌহার্দ্য স্থাপনের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।  

ইসলাম ধর্মের মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব হলো, ইসলাম প্রত্যেক মানুষকে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করে। এই স্বাধীনতা কেবল ধর্ম-বিশ্বাস লালন-পালন করার স্বাধীনতা নয় বরং ধর্ম না করার বা ধর্ম বর্জন করার স্বাধীনতাও এই ধর্মীয় স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘তুমি বল, তোমার প্রতিপালক-প্রভুর পক্ষ থেকে পূর্ণ সত্য সমাগত, অতএব যার ইচ্ছা সে ঈমান আনুক আর যার ইচ্ছা সে অস্বীকার করুক’ (সুরা কাহাফ, আয়াত : ২৮)।

সত্য ও সুন্দর নিজ সত্তায় এত আকর্ষণীয় হয়ে থাকে যার কারণে মানুষ নিজে নিজেই এর দিকে আকৃষ্ট হয়। বলপ্রয়োগ বা রাষ্ট্রশক্তি নিয়োগ করে সত্যকে সত্য আর সুন্দরকে সুন্দর ঘোষণা করানো অজ্ঞতার পরিচায়ক।

ফার্সিতে বলা হয়, সূর্যোদয়ই সূর্যের অস্তিত্বের প্রমাণ। এই নিয়ে গায়ের জোর খাটানোর বা বিতণ্ডার অবকাশ নেই। সূর্যোদয় সত্বেও কেউ যদি সূর্যের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, তাহলে তাকে বোকা বলা যেতে পারে কিন্তু তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কিছুই নেই।

ঠিক তেমনি কে আল্লাহকে মানলো বা মানলো না, কে ধর্ম পালন করলো বা করলো না, এটা নিয়ে এ জগতে বিচার বসানোর কোন শিক্ষা ইসলাম ধর্মে নেই। বরং এর বিচার পরকালে আল্লাহ নিজে করবেন বলে তার শেষ শরীয়ত গ্রন্থ আল কোরআনে বার বার জানিয়েছেন। এ স্বাধীনতা কাজে লাগিয়ে সমাজে আস্তিকও থাকবে, নাস্তিকও থাকবে। মুসলমানও থাকবে, খ্রিস্টানও থাকবে, হিন্দুও থাকবে এবং অন্যান্য মতাবলম্বীরাও থাকবে।

মহানবী (সা.) সমাজের সর্বক্ষেত্রে এবং সব জাতির মধ্যে শান্তি, শৃংখলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। এমনকি খ্রিস্টানদের নাগরিক ও ধর্মীয়-অধিকারকেও তিনি নিশ্চিত করেছেন এবং কেয়ামত পর্যন্ত তা যেন বলবত থাকে সেই ব্যবস্থাও করেছেন।

খ্রিস্টানদের নাগরিক ও ধর্মীয়-অধিকার নিশ্চিতকারী মহানবী (সা.) প্রদত্ত ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দের ঘোষণা পত্রে উল্লেখ রয়েছে, ‘এটি মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ (সা.) প্রণীত কাছের এবং দূরের খ্রিষ্টীয় মতবাদ পোষণকারী প্রত্যেকের জন্য ঘোষণা পত্র: আমরা এদের সঙ্গে আছি। নিশ্চয়ই আমি নিজে আমার সেবকবৃন্দ মদিনার আনসার এবং আমার অনুসারীরা এদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছি।

কেননা খ্রিস্টানরা আমার দেশের নাগরিক। আর আল্লাহর কসম! যা কিছুই এদের অসন্তুষ্টি ও ক্ষতির কারণ হয় তার ঘোর বিরোধী। এদের প্রতি বলপ্রয়োগ করা যাবে না, এদের বিচারকদেরকে তাদের দায়িত্ব থেকে অপসারণ করা যাবে না আর এদের ধর্মযাজকদেরকেও এদের আশ্রয় থেকে সরানো যাবে না।

কেউ এদের উপাসনালয় ধ্বংস বা এর ক্ষতিসাধণ করতে পারবে না। কেউ যদি এর সামান্য অংশও আত্মসাৎ করে সেক্ষেত্রে সে আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গকারী এবং তার রাসুলের অবাধ্য সাব্যস্ত হবে।

নিশ্চয়ই এরা (অর্থাৎ খ্রিস্টানরা) আমার মিত্র এবং এরা যেসব বিষয়ে শঙ্কিত, সেসব বিষয়ে আমার পক্ষ থেকে এদের জন্য রয়েছে পূর্ণ নিরাপত্তা। কেউ এদেরকে জোর করে বাড়ি ছাড়া করতে পারবে না অথবা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতেও এদের বাধ্য করা যাবে না।

বরং মুসলমানরা এদের জন্য যুদ্ধ করবে। কোনো খ্রিস্টান নারী যদি কোনো মুসলমানের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, সেক্ষেত্রে তার (অর্থাৎ সে মেয়ের) অনুমোদন ছাড়া এটি সম্পাদিত হতে পারবে না। তাকে তার গির্জায় গিয়ে উপাসনা করতে বাধা দেয়া যাবে না।

এদের গির্জাগুলোর পবিত্রতা অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। এগুলোর সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে বাধা দেয়া যাবে না। আর এদের ধর্মীয় অনুশাসনগুলোর পবিত্রতা-হানী করা যাবে না। এ ঘোষণা পত্র কিয়ামত দিবস পর্যন্ত এই উম্মতের সদস্য লঙ্ঘন করতে পারবে না। [অগ্রপথিক সীরাতুন্নবী (সা.) ১৪১৬ হিজরী, ১০ বর্ষ, ৮ সংখ্যা, ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-এর প্রকাশনা, ১ম সংস্করণ, আগষ্ট ১৯৯৫]

একটু ভেবে দেখুন, কি চমৎকার শিক্ষা! বিশ্বনবী, মহানবী (সা.) প্রতিষ্ঠিত নীতি হলো, যে যে ধর্মেরই হোক না কেন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাদের জাগতিক অবস্থান সমান। এটি নিছক একটি ঘোষণাই ছিল না।

বরং মহানবী (সা.) মদিনার শাসনকাজ পরিচালনাকালে এর সুষ্ঠ বাস্তবায়নও করেছিলেন। যারা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে বা যারা একাজে অতি উৎসাহী তাদের জন্য মহানবী (সা.)-এর বিদায় হজের ভাষণ থেকে একটি সতর্কবাণী উল্লেখ করে শেষ করছি।মহানবী (সা.) বলেন: ‘হে মানবমণ্ডলী! সাবধান, তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। কেননা তোমাদের পূর্বের জাতিগুলো ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে’ (ইবনে মাজা, কিতাবুল মানাসিক)।

ইসলাম ফেতনা সমর্থন করে না, বরং ধর্মের ব্যাপারে সদাচরণ ও ইনসাফ প্রদর্শনের উৎসাহ দিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ধর্মের ব্যাপারে যারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কার করেনি, তাদের সঙ্গে সদাচরণ ও ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না।’ (সুরা মুমতাহিনা : ৮)। সাম্প্রদায়িকতার নামে যারা বিশৃঙ্খলা করে তাদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে নবীজি (সা.) বলেন, ‘যারা মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে ডাকে, যারা সাম্প্রদায়িকতার জন্য যুদ্ধ করে এবং সাম্প্রদায়িকতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে তারা আমাদের সমাজভুক্ত নয়।’ (আবু দাউদ)

আর এভাবেই ইসলামে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির জন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা অপরিহার্য। দেশে বা সমাজে বসবাসরত সবার উচিত পারস্পরিক আচরণ সুন্দর করা ও সাহায্যের হাত প্রসারিত করা এবং হিংসা-বিদ্বেষের পরিবর্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা।

মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তাদের অধিকাংশ গোপন পরামর্শে কোনো কল্যাণ নেই, বরং কল্যাণ আছে যে দান-খয়রাত, সৎকাজ ও শান্তি স্থাপনের নির্দেশ দেয় তাতে। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় যে এমন করবে, আমি তাকে মহা পুরস্কার দান করব।’ (সুরা নিসা : ১১৪)। সুতরাং সবার উচিত ইসলামী আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে শান্তিময় সমাজ গড়ে তোলা।

আলোকিত রাঙামাটি

সর্বশেষ