রাঙামাটি । শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ , ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আলোকিত রাঙ্গামাটিঃ-

প্রকাশিত: ১০:৫৭, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০

ছোট বড় সবার হাতেই বৈঠা, হাজারো বছর ধরে পানিতেই বসবাস

ছোট বড় সবার হাতেই বৈঠা, হাজারো বছর ধরে পানিতেই বসবাস

ছবি: সংগৃহীত


চরদিকে পানি আর পানি। এরই মাছে ছোট ছোট খুপরি ঘর। সেখানেই বসবাস করে ভাসমান এক জাতি। এক টুকরা মাটির উপর দাঁড়ানোর ইচ্ছা তাদের পূরণ হয় না! এভাবেই তারা কাটিয়ে দিচ্ছে যুগের পর যুগ। 

 

নৌকাতেই তাদের দিন কাটে

 

ছোট ছোট তরী বয়ে চলে ভাসমান নদীর বুকে। এ ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতেও ভরসা ওই নৌকাগুলোই। এই পানির মাঝেই ফসল ফলানো হয়। নারী পুরুষ উভয়েই সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি নৌকা বেয়ে কৃষি কাজ ও ফসল সংগ্রহ করেন। এরপর সেগুলো নৌকায় বহন করে নির্দিষ্ট ঘর পর্যন্ত আবারো দাড় বেয়ে আসতে হয়। সেখানকার ছোট থেকে বড় সবাই নৌকা চালাতে পারদর্শী। বলছি মার্শ আরবের কথা। যারা প্রায় পাঁচ হাজার বছর ধরে এভাবেই ভাসমান অবস্থায় জীবন যাপন করছে।

 

মার্শ আরবদের বাড়ি

 

মরুভূমির এই জলাভূমিতে মার্শ আরবরা এভাবেই যুগের পর যুগ পার করছেন। তাদের বাসস্থানগুলো বেশ আকর্ষণীয়। এসব বাড়িগুলো তৈরি করা হয় ফ্রেগমাইটস (এক জাতীয় গাছ) দিয়ে। যা ওই জলাভূমিতে প্রাকৃতিকভাবেই উৎপন্ন হয়। তাদের বাড়িগুলো যে কাঠামোতে তৈরি করা হয় তাকে বলা হয় মুদিফ। অবাক করা বিষয় হলো, এসব বাড়ি কোনো প্রকার কাঠ, লোহা, পেরেক, কাঁচ ছাড়াই তৈরি করা হয়। 

 

নৌকাই তাদের যাতায়াতের বাহন

 

একটি বাড়ি তৈরি করার পূর্বে সেখানে খড়কুটো আর মাটি জমা করে দ্বীপের মতো করা হয়। নৌকায় মাটি ও খড় সংগ্রহ করে তারা যে স্থানে দ্বীপ গড়তে চান সেখানে জড়ো করেন। এরপর সেই স্থানে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে বাড়ি তৈরি করা হয়। মার্শ আরবদের বাড়িগুলো উপর থেকে দেখতে এজন্যই হাজারো দ্বীপের সমষ্টি বলে মনে হয়। জানেন কি? মার্শ আরবের এই স্থানটি ভেনিস অব মেসোপটেমিয়া বলেও পরিচিত।

 

ভাসমান নগরী

 

বিশ্বের প্রথম ও প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার স্থানটি ছিল বর্তমান ইরাকের দক্ষিণাঞ্চল। সেই স্থানটিতেই মার্শ আরব অবস্থিত। প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে ইরাকের তাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর সংযোগস্থলে একটি পরিবেশবান্ধব ভাসমান গ্রাম গড়ে উঠে। নয় হাজার বর্গমাইলের ভাসমান এই মার্শ আরব গ্রামে প্রায় দেড় হাজার আদিবাসীর বসবাস। তারাই মার্শ আরব ও মা ডান উপজাতি নামে পরিচিত।

 

নৌকায় ফসলের বোঝা

 

ইংরেজি মার্শ শব্দের অর্থ হলো জলাভূমি। মরুভূমির মাঝখানে জলাভূমি সত্যিই এক আশ্চর্যের বিষয়। বিশ্বের আর কোথাও এমন নিদর্শন নেই। জানা যায়, সুমেরীয় সভ্যতার পতনের পর আরবদের আয়ত্তে এই স্থানটি চলে আসে। পরবর্তীতে মাদান নামক আরব উপজাতিরা এই জলাভূমিতে বসবাস করা শুরু করলে তারাই মার্শ আরব নামে পরিচিত হয়।

 

জলভূমির এই গাছ দিয়েই ঘর তৈরি করা হয়

 

স্থাপত্যে অনন্য মার্শদের বাড়িগুলো। অত্যন্ত সহজেই তারা এসব বাড়ি তৈরি করতে পারেন। এমন এক বাড়ি কিনা ২৫ বছরেও অক্ষত থাকে। তাদের এই নির্মাণশৈলী দেখে ২০০৩ সালে ইরাক সরকার ইরাকের অন্য অঞ্চলের মানুষদেরকেও শিখতে উৎসাহিত করেছিল। জানেন কি? এ বাড়িগুলোর বিভিন্ন সুবিধা রয়েছে। পুরো বাড়িটিই অন্য স্থানে বহন করতে পারে তারা। বসন্তে জলাভূমির পানির উচ্চতা বেড়ে গেলে তারা ঘরগুলো অন্য উঁচু ভূমিতে নিয়ে স্থাপন করে। 

 

নারী পুরুষ উভয়েই উপার্জন করে থাকেন

 

জলবায়ুর সঙ্গে দিন-রাত লড়াই তাদের

যুগ যুগ ধরে সেখানে বসবাস করলেও অত্যন্ত কষ্টে জীবন ধারণ করেন তারা। খাবার পানির সংকট সেখানে লেগেই থাকে। সেইসঙ্গে মার্শ আরবদের অনেকেই জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষির উপর নির্ভরশীল। তবে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, খরা এবং ঘন ঘন বালি ঝড়ের কারণে তাদের কৃষিকাজে ক্ষতি হয়। খড়ের উত্পাদন হ্রাস পেলেই তীব্র বাতাস বা ঝড়ের মুখোমুখি হন তারা।

 

স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ছোট বড় সবাই

 

মার্শ আরব জনগণের উপর জলবায়ুর প্রভাব মারাত্মক আকার ধারণ করে। এছাড়াও বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগে থাকেন এই বাসিন্দারা। শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা, ক্যান্সার এবং শিশু মৃত্যুর হার বেশ উদ্বেগজনক আকারে বাড়ছে। বিশেষ করে নারী ও শিশু স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে সেখানকার প্রকৃতি। কারণ প্রকৃতি কখনো চরম নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। 

কৃষিকাজ ও জীবিকা নির্বাহ পদ্ধতি

প্রতি বছরের এপ্রিল মাসে যখন জলাভূমিতে পানির গভীরতা কমে আসে। তখন তারা ফসলের চারা রোপণ করেন। এছাড়াও জলাভূমিতে মাছ ধরেও অনেকে জীবিকা নির্বাহ করে। এই জলাভূমির মাছ শিকার করেই সমগ্র ইরাকে মাছ সরবরাহ করা হয়। এছাড়াও বিগত শতাব্দী থেকে মার্শ আরবেরা নলখাগড়া দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে কার্পেট বুননকেও তাদের পেশা বানিয়ে নিয়েছে। 

 

মার্শ আরবদের মেরুদণ্ড হলো সেখানকার নারীরা

 

মার্শ আরবের নারীরা সেখানকার অর্থনীতির একটি বড় দায়িত্ব পালন করেন। পুরুষরা বেশিরভাগ সময়ই বাইরে কৃষিকাজ অথবা খড় সংগ্রহে ব্যস্ত থাকেন। আর তখন নারীরা খাগড়া সংগ্রহ (এক জাতীয় গাছ), গরুর বা মহিষ পালন এবং দুধ, পনির এবং দই তৈরি করতে ব্যস্ত থাকেন। আবার অনেকেই পোশাক, স্কার্ফ এবং হস্তশিল্প তৈরির পাশাপাশি সন্তান পালন, রান্না করা সবই করেন। দিন শেষে নারীরা তাদের পরিশ্রমের ফল স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন। মার্শ আরব সম্প্রদায়ের মেরুদণ্ডই হলো নারীরা। ভাসমান এই অঞ্চলের নারীরা বোরকা পরেই বাইরে বের হয়ে থাকেন। 

 

ভাসমান এক বাড়ি

 

মার্শ আরবদের ধর্ম

মার্শ আরবের অধিবাসীরা শিয়া মুসলিম। সমাজ ব্যবস্থা আরবের অন্যান্য গোত্রভিত্তিক সমাজের মতোই। তারা পেশাগতভাবে মূলত দুই ভাগে বিভক্ত, একদল ষাড় লালন পালন করেন। আরেকদল জলাভূমিতে ধান, যব আর গমের চাষ করে। 

 

নারীরা ঘরে বাইরে অত্যন্ত পরিশ্রম করেন

 

২০০৩ সালে মার্কিনীরা আসলে বাঁধের বিভিন্ন অংশ ভেঙ্গে দিয়ে অঞ্চলটিকে পুনরায় জলমগ্ন করার প্রয়াস চালানো হয়। ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তকমা পাওয়া এই অঞ্চলটি ধীরে ধীরে আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। বর্তমান ইরাক সরকার মার্শ আরবদের হাজার বছরের ঐতিহ্যকে রক্ষার চেষ্টা করছে। মার্শ আরবদের এই কুঁড়ে ঘর পর্যটকদের অতিথিশালা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

আলোকিত রাঙামাটি