রাঙামাটি । শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ , ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নিউজ ডেস্কঃ-

প্রকাশিত: ১২:২৩, ১৯ ডিসেম্বর ২০২০

দেশেই তৈরি হবে বাস, ট্রাক ॥ অটোমোবাইল শিল্পে বিপুল সম্ভাবনা

দেশেই তৈরি হবে বাস, ট্রাক ॥ অটোমোবাইল শিল্পে বিপুল সম্ভাবনা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ২০৩১ সালের মধ্যে দেশেই তৈরি হবে বাস, ট্রাক, অটোরিক্সা ও বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। তৈরি হবে পরিবেশবান্ধব বৈদ্যুতিক মোটরযানও। জাপানের মিৎসুবিশি কর্পোরেশনের সহযোগিতায় প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ দেশে গাড়ি তৈরি করার কথা জানিয়েছে। বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে জাপানের অটোমোবাইল জায়ান্ট টয়োটাও। এছাড়াও ভারত, মালয়েশিয়া, চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অটোমোবাইল খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা দেখছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। অটোমোবাইল খাতে বিনিয়োগে দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করতে বিপুল প্রণোদনার প্রস্তাবসহ ‘অটোমোবাইল শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা, ২০২০’-এর খসড়া প্রকাশ করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। খসড়া নীতিমালাটি সম্প্রতি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে স্টেকহোল্ডারদের মতামত চেয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। 

জানা যায়, বর্তমানে বাণিজ্যিক গাড়ির বাজার প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার, অথচ এটি এক দশক আগেও প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ছিল। খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৮ সালে অন্তত ৩৫ হাজার ইউনিট বাস, ট্রাক, অটোরিক্সা, কার্গো ভ্যান, পিকআপ ও ট্যাংকার বিক্রি হয়েছে, যেখানে ১০ বছর আগেও এই পরিমাণ ছিল ২০০০ ইউনিট। এছাড়া গত দশকে বাণিজ্যিক যানবাহনের বাজারের আকার প্রতিবছর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ করে বাড়ছে। ব্যবসায়ীরা জানান, পণ্য আমদানি-রফতানি বাড়ার কারণে বাণিজ্যিক যানবাহনের চাহিদা বাড়ছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বৃদ্ধি, দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনে বাস-ট্রাকের চাহিদা কয়েক গুণ বেড়েছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাণিজ্যিক যানবাহনগুলোর বিক্রি বছরে ১০.৬৫ শতাংশ হারে বেড়েছে এবং ২০১৮ সালে এই বিক্রি বেড়ে দাঁড়ায় ২৫,৯৮০ ইউনিট। আর এদের মধ্যে ট্রাকের বিক্রয় হার সবচেয়ে বেশি। প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৮ সালে ১২,৬৬৩ ইউনিট ট্রাক বিক্রি হয়েছিল, ২০১৭ সালে ছিল ১০ হাজার ৩৬৩ ইউনিট। অর্থাৎ বিক্রি বেড়েছে ২২.৩১ শতাংশ। লরির বিক্রিও বেড়েছে ১০.৬৮ শতাংশ। ট্রাক্টরের বিক্রি বেড়েছে ২৮ শতাংশ। ২০১৮ সালে মোট বাস বিক্রি হয় ২৭৫৫ ইউনিট, যেখানে ২০১৭ সালে ছিল ৩৭৬০ ইউনিট।

জানা যায়, দেশে এখন ১৪ থেকে ১৫টি বড় অটোমোবাইল পরিবেশ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাদের মধ্যে পাঁচ-ছয়টি প্রতিষ্ঠানের রয়েছে নিজস্ব সংযোজন কারখানা। বাকিরা শুধু পরিবেশক বা আমদানিকারক। বাংলাদেশে অটোমোবাইলের প্রধান প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ইফাদ অটোস, আফতাব অটো, নাভানা, র‌্যাংগস মোটরস, রনকন মোটরস, নিটল মোটর, রানার মোটর, এজি অটোমোবাইল, এসিআই মোটরস ইত্যাদি। উদ্যোক্তাদের মতে, অর্থনীতির গতি বাড়ছে বলে বাংলাদেশ বাণিজ্যিক যানবাহনের জন্য একটি সম্ভাব্য বাজার তৈরি হয়েছে। বাণিজ্যিক যানবাহনগুলোর চাহিদা দিন দিন বাড়বে। কারণ পণ্য পরিবহন ও মানুষের গতিবিধির জন্য যানবাহন দরকার। তাঁদের মতে, যখনই রাস্তাঘাট ও নতুন সংযোগ হবে তখনই গাড়ির চাহিদা বাড়বে। আগামী বছর পদ্মা সেতু পুরোপুরি চালু হলে দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগে চাহিদা আরও বাড়বে। বাড়বে গাড়ির চাহিদাও। এজন্য অটোমোবাইল খাতে বিনিয়োগে দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করতে বিপুল প্রণোদনার প্রস্তাবসহ ‘অটোমোবাইল শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা, ২০২০’-এর খসড়া প্রকাশ করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। খসড়া নীতিমালাটি সম্প্রতি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে স্টেকহোল্ডারদের মতামত চেয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়।

জানতে চাইলে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন জনকণ্ঠকে বলেন, অটোমোবাইল খাতের সম্ভাবনা কাজে লাগাতেই প্রণোদনার বিস্তারিতসহ খসড়া নীতিমালাটি প্রকাশ করেছি। জাপানের সহায়তা নিয়ে নীতিমালাটি তৈরি করা হয়েছে।

এর আগে গত বছর ঢাকায় নিযুক্ত জাপানী রাষ্ট্রদূত ইতো নাউকি শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের সঙ্গে সাক্ষাত করে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে জাপান ইকোনমিক জোনে টয়োটার বিনিয়োগ আগ্রহের কথা জানান। রাষ্ট্রদূত অটোমোবাইল শিল্পের জন্য একটি বাস্তবসম্মত নীতিমালা প্রণয়নেরও পরামর্শ দেন। এ প্রেক্ষিতেই নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু করা হয়। গত সেপ্টেম্বরে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সঙ্গে সাক্ষাতকালেও জাপানী রাষ্ট্রদূত টয়োটার বিনিয়োগের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশের অটোমোবাইল খাতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ রয়েছে। অবশ্যই, এই নীতিমালা বাস্তবায়নের ফলে এই খাতে বিনিয়োগ বাড়বে। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশি বিদেশী বিনিয়োগ দেশে আসতে শুরু করবে। বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (বিল) নামে একটি স্থানীয় সংস্থা গত বছর চট্টগ্রামে একটি অটোমোবাইল কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে ১০০ একর জমিতে নির্মিত এই কারখানায় প্রাথমিকভাবে এই প্রতিষ্ঠানটি ২০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে বলে জানিয়েছেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান।

নীতিমালায় দেশে সিকেডি অটোমোবাইল ও পার্টস উৎপাদন কারখানা স্থাপনে আগ্রহী দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারী ও দেশে উৎপাদিত সিকেডি ও এসেম্বলিং যানবাহন রফতানিতে শুল্ক ও করে বিশাল ছাড় দেয়ার পাশাপাশি নগদ প্রণোদনারও প্রস্তাব করা হয়েছে। নীতিমালায় বাংলাদেশের বিকাশমান অর্থনীতি ও বিপুল জনগোষ্ঠীর চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে বাস, ট্রাক, অটোরিক্সা ও তার যন্ত্রাংশ তৈরি, পরিবেশবান্ধব বৈদ্যুতিক মোটরযান তৈরি এবং এজন্য দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। নীতিমালায় ২০২১ সাল থেকে ১০ বছরে বাংলাদেশ অটোরিক্সা থেকে সাভ, প্যাসেঞ্জার কার থেকে বাস-ট্রাকের অন্তত ৩০-৫০ শতাংশ দেশেই তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, স্থানীয় যন্ত্রাংশ উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে অটোমোবাইল শিল্পের বিকাশে এসেম্বলার্স ও মূল যন্ত্রপাতি উৎপাদকদের সহায়তা দেবে সরকার। স্থানীয় উৎপাদকদের সুরক্ষা দিতে আমদানি শুল্ক বাড়ানো ও উৎপাদনখাতে বিনিয়োগকারীদের কর ছাড় দেয়া হবে। প্যাসেঞ্জার কার, থ্রি-হুইলারস, বাস, ট্রাক, ট্রাক্টরসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক যানবাহন, এ্যাম্বুলেন্স ও এর যন্ত্রাংশ উৎপাদন ও এসেম্বলিং কারখানা স্থাপনে বিশেষ প্রণোদনা দেবে সরকার। আমদানি বিকল্প যন্ত্রাংশ উৎপাদনকারী কারখানা ৭-৮ বছরের কর অব্যাহতি সুবিধা পাবে।

এতে আরও বলা হয়, অটোমোবাইল খাতে বিনিয়োগকারীরা তাদের বার্ষিক টার্নওভারের ১ শতাংশ গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে ব্যয় করলে তারা কর মওকুফ সুবিধা ও আমদানি শুল্কে বিশেষ রিবেট পাবেন। স্বয়ংসম্পূর্ণ অটো-ডিজাইন প্রতিষ্ঠান স্থাপনে ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানির ক্ষেত্রেও বিনিয়োগকারীরা কর সুবিধা পাবেন। বৈদ্যুতিক শক্তিচালিত গাড়ির উপাদান, ব্যাটারি বা চার্জিং স্টেশন স্থাপনে সরকার বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করবে। এজন্য প্রযুক্তি আহরণের সুবিধার্থে একটি তহবিল গঠন করবে সরকার। খসড়া নীতিতে একটি অটো পার্টস উৎপাদন উন্নয়ন ফান্ড গঠনের কথা বলা হয়েছে, যার মাধ্যমে যন্ত্রাংশ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তা দেয়া হবে।

খসড়া নীতিমালায় প্রস্তাব করা বিভিন্ন সুবিধা ও প্রণোদনার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা গেলে তা অটোমোবাইল খাতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, এরকম একটি নীতি প্রণয়নের জন্য এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সরকারকে অনুরোধ জানিয়ে আসছেন তারা।

নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, অটোমোবাইল খাতে বিনিয়োগ নিয়ে দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তাদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। খসড়া নীতিমালাটি চূড়ান্ত করে কার্যকর করা হলে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়বে। তিনি জানান, ‘আমরা কিশোরগঞ্জে ইতোমধ্যেই বিদ্যুতচালিত গাড়ি উৎপাদনের প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজ শুরু করেছি। কোভিডের কারণে কার্যক্রম আপাতত স্থগিত আছে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে এবং বিদেশীদের আসা-যাওয়া শুরু হলে প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজ পুরোদমে শুরু হবে। আগামী দুই বছরের মধ্যে আমরা গাড়ি উৎপাদন করতে পারব।’

পিএইচপি অটোমোবাইলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আখতার পারভেজ বলেন, ‘এটি স্থানীয় অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রিকে উৎসাহ যোগানোর একটি সাময়িক নীতিমালা। এই নীতিমালা প্রণয়ন করলে আমাদের মানুষদের আর পুরনো গাড়ি চালানোর দরকার পড়বে না। সেকেন্ড হ্যান্ড কার আমদানি করতে হবে না আমাদের। বাংলাদেশে তৈরি ব্র্যান্ড নিউ কার আমরা ব্যবহার করতে পারব। একটি ব্র্যান্ড নিউ কার তৈরি করার জন্য আমাদের ৮৩৩২ ধরনের বিবিধ যন্ত্রাংশের প্রয়োজন পড়ে। এই নীতিমালা থেকে স্থানীয় উৎপাদনকারকরা যদি সুবিধা লাভ করে, তাহলে বাংলাদেশে খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরির শত শত কারখানা প্রতিষ্ঠিত হবে আর তা আমাদের অর্থনীতিতে রাখবে বড় ভূমিকা।

অটোমোবাইল কারখানা স্থাপনে গত বছর উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (বিএআইএল)। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে ১০০ একর জমির ওপর ওই কারখানায় প্রাথমিকভাবে ২০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে কোম্পানিটি। পরবর্তী ৫ বছরে এই প্ল্যান্টে ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মাসুদ কবির। স্থানীয় গবেষণা সংস্থা লাইট ক্যাসেলের তথ্যানুযায়ী, ১০ বছর আগে বাংলাদেশের অটোমোবাইল মার্কেটের আকার ছিল ৫০০ কোটি টাকারও কম। ২০১৯ সালে তা বেড়ে প্রায় ১৪০০ কোটি টাকা কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।বছর পর্যন্ত এলডিসি হিসেবে প্রাপ্য সব সুবিধা পেতে থাকবে। এ সিদ্ধান্ত সম্ভব হলে তা হবে বিশ্ববাণিজ্য অঙ্গনে সব এলডিসির জন্য অসাধারণ প্রাপ্তি।

সূত্রঃ দৈনিক জনকন্ঠ

আলোকিত রাঙামাটি