রাঙামাটি । বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ , ১৩ চৈত্র ১৪৩০

সাইফুল বিন হানিফ

প্রকাশিত: ১৩:১২, ২৫ মে ২০১৯

নজরুলেশ্বর: যে ঈশ্বরে আমার বিশ্বাস

নজরুলেশ্বর: যে ঈশ্বরে আমার বিশ্বাস

 

বল বীর-
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারী' আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রীর!
বল বীর-
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি'
চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি'
ভূলোক দ্যূলোক গোলোক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!

১৯২১ সালে ডিসেম্বর মাসে শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে এই অগ্নিক্ষরা কবিতা বিদ্রোহী রচনা করেন মাত্র ২২ বছর বয়সে প্রবল আত্নবিশ্বাসী তরুণ কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সেই সময়কার রাষ্ট্রনীতিক পেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে তাকে ‘বিদ্রোহী কবি’ আখ্যা দেয়া হয়।
১৯২০ দশকে ভারতবর্ষে এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে নির্লজ্জ জালিওয়ান বাঘ হত্যাকাণ্ড ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে চরম পর্যায়ে নিয়ে যায়। নজরুলও সেই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিশের দশকে গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে প্রচারেও যোগ দেন নজরুল। অসহযোগ আন্দোলন যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে সেই সময় গান্ধীজী যুব সমাজকে নিরস্ত্র হতে বললেন। বহুদিন ধরে বাংলার দরিদ্র কৃষক শোষণ, জাতি বৈষম্য, ধর্মান্ধতা চলে আসছিল। নজরুল এই সব সামাজিক, রাষ্ট্রনীতিক ও অর্থনীতিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চার করেছিলেন তাই তিনি সমস্ত আবেগ দিয়ে রচনা করেন ‘বিদ্রোহী কবিতা’

১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে ২৪ মে পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে কাজী পরিবারে নজরুলের জন্ম। এই কাজী পরিবার বিহার থেকে বাংলায় বসবাস করতে আসে। তার পিতা মসজিদের ইমাম ছিলেন। দারিদ্রের মধ্যে জন্ম হওয়ায় তার নাম রাখা হয় দুখু মিয়া। জন্মস্থান চুরুলিয়ায় ধ্বংসাবশেষের মধ্যেই তিনি বড় হন। এই ইতিহাস প্রসিদ্ধ হিন্দু রাজার গড়ের ধ্বংসাবশেষের বর্ণনা পাওয়া যায় তার কিশোর বয়সে লেখা কবিতা ‘ভগ্নস্তুপ’ এ । নজরুল গ্রামের মোক্তবে পড়াশোনা শুরু করলেও আট বছর বয়সে পিতার অকাল মৃত্যুতে তিনি সংসারের প্রতিপালনের জন্য মাজারের খাদেমের কাজ ও মোল্লাগিরি করতে বাধ্য হন। 

শীঘ্রই তিনি ওই অঞ্চলের ভ্রাম্যমাণ লোকসংস্কৃতির দল  ‘লেটোদল’-এ যোগ দেন। লেটোদলের হয়ে নাটক ও গান রচনা করতে গিয়ে হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী ও বাংলা লোকসংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হন। বৃত্তি পাওয়া মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও নজরুলের ছাত্রজীবন দারিদ্রের কারণে বার বার ব্যহত হয়। দারিদ্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে তাকে রুটি তৈরির কাজসহ নানা ধরনের কাজ করতে হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রাচীর পত্রে বাঙালি যুবকদের সৈন্যদলে যোগ দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে দেখে নজরুল ব্রিটিশ সৈন্যদলে ঊনপঞ্চাশ নম্বর বাঙালি পল্টনে নাম লেখান। নজরুল যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ না করলেও নওশেরা ও করাচিতে থাকার সময় তিনি ফার্সি চর্চা ছাড়েননি। সংবাদপত্রের মাধ্যমে নজরুল বিশ্বের সমসাময়িক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে লাগলেন। যেমন- ভোশ্লেভিক বিপ্লব। ১৯১৯ খ্রিষ্ট্রাব্দে একটি উদারনীতি মুসলিম পত্রিকায় তার প্রথম লেখা ‘বাউন্ডুলের আত্নকাহিনী’ প্রকাশিত হয়। এরপর বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকায় নজরুলের বেশ কিছু কবিতা ছাপা হয় যার মধ্যে প্রথম প্রকাশিত কবিতার নাম ‘মুক্তি’। এই পাক্ষিক পত্রিকার কর্ণধার ছিলেন কমরেড মুজাফফর আহমেদ। সৈনিক জীবন থেকে প্রত্যাবর্তনের পর কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী এই ব্যক্তির সঙ্গে নজরুল ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন। মুজাফফর আহমেদের সান্নিধ্যে আসার পর বাংলার বাঘ খ্যাত এ.কে.ফজলুল হকের সহায়তায় নজরুল প্রত্যাহিক ‘নবযুগ’ পত্রিকা বের করেন। রাষ্ট্রনীতিক প্রবন্ধে তিনি আমাদের দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের সঙ্গে রুশ বিপ্লব, আইরিশ বিদ্রোহ এবং কামাল আতাতুর্কের নতুন তুর্কীর তুলনা করেছেন। এই পত্রিকায় কৃষিজীবী ও শ্রমিজীবী মানুষের কথা তিনি বার বার তুলে ধরেন। সরকারের নিষেধাজ্ঞা না মেনে সরকার বিরোধী লেখা প্রকাশ করার জন্য সরকার ‘নবযুগ’ বন্ধ করে দেয় ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে। এরপর সঙ্গীত নজরুলের জীবনে প্রধান অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়। উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তালিম নেন এবং নওশেরাতে থাকার সময় গজলের সঙ্গে পরিচিত হন। রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে নজরুল প্রথম গায়ক হিসাবে পরিচিত লাভ করেন। নজরুল তার সৃষ্ট গানে আরবি ও ফার্সি ভাষা মিশিয়ে নতুন মাত্রা এনেছিলেন এবং তিনিই প্রথম বাংলা গজলের প্রবর্তক।

১৯২২ খ্রিস্টাব্দে নজরুল নিজে প্রকাশ করেন দ্বিপাক্ষিক পত্রিকা ‘ধুমকেতু’। প্রখ্যাত সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নজরুলকে উৎসাহিত করে বলেন- তিনি যেন শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে নির্ভয়ে সত্যি কথা বলতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ ধূমকেতুকে স্বাগত জানিয়ে বললেন- এখনও যারা অচেতন হয়ে আছে ধূমকেতু যেন তাদের জাগিয়ে তুলে।

আমি জানি জানি ঐ স্রষ্টার ফাঁকি, সৃষ্টির ঐ চাতুরী,
তাই বিধি ও নিয়মে লাথি মেরে, ঠুকি বিধাতার বুকে হাতুড়ি।
আমি জানি জানি ঐ ভুয়া ঈশ্বর দিয়ে যা হয়নি হবে তাও!
তাই বিপ্লব আনি বিদ্রোহ করি, নেচে নেচে দিই গোঁফে তাও!

মানুষের প্রতি নানা ধরনের অন্যায় অবিচার যা মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেছিল তারই প্রতিবাদ পত্র ধূমকেতু । হিন্দু-মুসলিম ধর্মের উদ্ধৃতি দিয়ে নজরুল তার প্রতিবাদের ভাষা তৈরি করেছিলেন। দূর্গার অসুর নিধন শক্তির আঁধারে লেখা আনন্দময়ীর আগমনে এবং শিবের প্রলয় নাচনের তাৎপর্য বর্ণনা করে তিনি ‘প্রলয় উল্লাস’ লিখেছিলেন। একইসঙ্গে মহরম, কারবালা, মক্কা, মদিনা ও জমজমের উপর প্রবন্ধে লিখে মুসলিম ঐতিহ্য তুলে ধরে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ধুমকেতুর সংখ্যায় তিনি লিখলেন- সবচেয়ে বড় ধর্ম হল ‘মানবিকতা’ তার প্রধান লক্ষ্য ছিল ‘হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি এবং ঐক্য।

মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান
মুসলিম তার নয়নমনি, হিন্দু তাহার প্রাণ।

এই কারণে রক্ষণশীল মুসলিম পত্রিকা তাকে কাফের বলে এবং গোড়া হিন্দু সমাজ তাকে বর্জন করে। এ প্রসঙ্গে নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেন বলেন- আমি মনে করি নজরুলের বিদ্রোহী সত্ত্বা শুধুমাত্র বিদ্রোহ প্রকাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি যেসব বিষয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন তা আজও প্রাসঙ্গিক। তিনি বিদ্রোহ করেছিলেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে। 

১৯২২ খ্রিস্টাব্দে নভেম্বর মাসে ধূমকেতু বন্ধ করে দেয় এবং নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে ব্রিটিশ রাজ সরকার । আত্মপক্ষ সমর্থন করে তেজদীপ্ত কণ্ঠে নজরুল বলেছিলেন আমার বাঁশি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে বলে সুর থেমে থাকবে না। কারণ সুর আমার বাঁশিতে নেই, আছে হৃদয়ে। 

কারারুদ্ধ নজরুলের কলম থেমে থাকেনি। তিনি লিখলেন শিকল পরার গান এবং সৃষ্টি সুখের উল্লাসের মত প্রাণ মাতানো কবিতা। জেলে দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে নজরুল অনশন শুরু করেন ১৯২৩ সালের মে মাসে। চল্লিশ দিনের অনশনে তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের স্বার্থে তাকে অনশন ভঙ্গ করার টেলিগ্রাম করেন।

শ্রান্ত-ক্লান্ত জাতির জীবনে বসন্তের হাওয়া বইয়ে দিবেন এই আশায় গীতিনাট্য ‘বসন্ত’ নজরুলকে উৎস্বর্গ করলেন কবিগুরু। অবশেষে তার অনশন ভঙ্গ করেন।
কুমিল্লার সেনগুপ্ত পরিবারের স্নেহ ভালোবাসায় নজরুল মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এই সময় তিনি বিরজা সুন্দরীর ভাসুরের মেয়ে প্রমিলার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন। ১৯২৩ সালে ডিসেম্বর মাসে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি কুমিল্লায় গিয়ে প্রমিলার পাণী প্রার্থী হন এবং প্রমিলাকে তিনি বিজয়িনী আখ্যা দেন।

১৯২৪ সালে এপ্রিল মাসে কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে প্রমিলা সেনগুপ্তের বিয়ে হয়। কাজী নজরুল ইসলাম চাননি যে তার স্ত্রী ধর্মান্তরিত হন। এই বিবাহ বৈধ করার জন্য একটি নতুন আইন করা হয় কিন্তু সেই সময় রক্ষণশীল সমাজ এ বিয়েকে মেনে নিতে পারে নি। ফলে তারা এ বিয়েকে বর্জন করেছিল। বলেন-কাজী কল্যাণী।
নজরুল প্রেমের বন্যায় ভেসে গেলেন। এ গানে প্রিয়া ও বাসর ঘরকে সাজিয়ে ছিলেন কল্পনায় প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ দিয়ে।

জোসনার সাথে চন্দন দিয়ে
মাখাবো তোমার গায়
রামধনু হতে লাল রঙ ছানি
আলতা পরাবো পায়
আমার গানের সাত সুর দিয়ে
তোমার বাসর রচিব প্রিয়া।

নারী-পুরুষের সমঅধিকারের দা তুলে তিনি তার ‘নারী’ কবিতায় লিখলেন- মাথার ঘোমটা ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙ্গে ফেল এ শিকল।
১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় সাম্প্রাদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। ব্যথিত নজরুল বললেন- 

এ হৃদয়ই মসজিদ, মন্দির, গির্জা
হৃদয় থেকে কোনো মন্দির বা কাবা হয় না।

হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রাদায়িক উত্তেজনা দূর করতে নজরুল ১৯২৬ সালে লিখলেন তার সাড়া জাগানো গান ‘কাণ্ডারি হুঁশিয়ার’ 
সুভাষ বসু বললেন- ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ উদ্দীপন সঙ্গীত হচ্ছে- 

দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে,
লঙ্গিতে হবে রাত্রি নিশিতে যাত্রীরা হুঁশিয়ার।

১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে অক্টোবর মাসে গভীর মানসিক যন্ত্রণায় তিনি লিখলেন- ‘দারিদ্র’ কবিতা। এ বছরেই নজরুল আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হন। এ সময় তার দ্বিতীয় পুত্রের জন্ম হওয়ায় ব্যথিত নজরুল সঙ্গীতের মধ্যে আবার খুঁজে পেলেন প্রেরণা, যে প্রেরণার উৎস ছিল প্রিয় পুত্র অরিন্দাম খালেদ। যাকে তিনি আদর করে বুলবুল বলে ডাকতেন। তারই নামে নজরুল তার প্রথম গজল রচনা করেন-

বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শখাতে দিসনে আজি দোল।

দু’বছরের মধ্যে নজরুল প্রচুর গজল ও গান রচনা করেন এবং গানগুলি স্বরলিপি সহকারে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপানো হয়। নজরুলের গানকে বিপুলভাবে জনপ্রিয় করতে সাহায্য করেছিলেন শ্রী দিলিপ কুমার রায়। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার অধিকৃত গ্রামোফোন কোম্পানি নজরুলের সাংগীতিক প্রতিভার আকৃষ্ট হয়ে তাকে বিশেষ পারিশ্রমিকের বিনিময়ে গ্রামোফোন কোম্পানির গীত রচয়িতা, সুরকার এবং প্রশিক্ষকের কাজে নিয়োগ করেন। এর ফলে নজরুলের সাংগীতিক জীবনের অগ্রগতি আরোও প্রবল হয়। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে ১৫ ই ডিসেম্বর কলকাতার এলবার্ট হলে জাতির পক্ষ থেকে নজরুলকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তার ভাষণে বলেন- নজরুল ইসলাম শুধু মুসলমানের কবি নন, বাংলার কবি, বাঙালির কবি।

সুভাষ চন্দ্র বলেন- আমরা যখন যুদ্ধে যাবো তখন নজরুলের গান গাইবো। যখন জেলে যাবো তখনও নজরুলের গান গাইবো। 
কয়েক দশক পরে ব্রিটিশদের বিতাড়িত করতে সুভাষ বসুর আজাদিন ফৌজ জাপানিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যখন ভারতের সীমান্ত পার হয়েছিলেন তখন নজরুলের-

চল চল চল উর্ধব গগনে বাজে মাদল
নিম্নে উতলা ধরণী তল।

সেনাদের অনুপ্রেরণা জাগিয়ে ছিল। নজরুল সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে প্রাণাধিক প্রিয় বুলবুল দুরারোগ্য বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। যদিও নজরুলের আরো দুটি পুত্র সন্তান ছিল তবুও তিনি বুলবুলের বিয়োগ ব্যথা কিছুতেই ভুলতে পারেন নি। পরের বারো বছর তিনি সঙ্গীত সৃষ্টিতে ডুবে ছিলেন। প্রায় তিন হাজারের অধিক গান রচনা করে তাতে সুর সংযোজন করেন যা রবীন্দ্রনাথের গানের চেয়ে বেশি। 

নজরুল তার সঙ্গীত সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছিলন। তিনি তার গানে মার্গ সঙ্গীত থেকে লোক সঙ্গীত, পারস্য দেশের গজল থেকে দক্ষিণ ভারতীয় সঙ্গীত, ইসলামী ভাবধারা থেকে হিন্দু ধর্মীয় সঙ্গীতের ভাবধারা প্রয়োগ করেছেন। বলেন—অনিন্দিতা কাজী 

মার্গ সঙ্গীত আঁধারিত নজরুলের অনেক প্রেমের গান জাগতিক কামনা-বাসনাকে বিষয়বস্তু করে লেখা। রাবীন্দ্রিক ভাব ভাবনা এবং নীতি-বাগীস ব্রাহ্ম সমাজে তা বিস্ময়ের কারণ হয়েছিল।

বুলবুলের মৃত্যুর পর নজরুল অধ্যাত্যবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং তান্ত্রিক মতে যোগ সাধনায় মগ্ন হন। এই সময় তিনি কীর্তন ও শ্যামা সঙ্গীতসহ বেশ কিছু ভক্তিগীতি রচনা করেন।

একই সময় তিনি কোরআনের ৩৮ টি পরিচ্ছেদ, হাফিজ ও ওমর খৈয়ামের কিছু অংশ অনুবাদ করেন।

নজরুলের ইসলামি গানকে জনপ্রিয় করেন প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী আব্বাস উদ্দীন। এর ফলে মোল্লাদের মনে সঙ্গীত সম্পর্কে যে বিরুপ ধারণা ছিল তা দূর হয় এবং মুসলিম রক্ষণশীলতাকে অনেকটা শিথিল করে।

১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে নজরুল মঞ্চ ও চলচ্চিত্রে জগতে প্রবেশ করেন। নজরুল সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে কলকাতা বেতার কেন্দ্রেও যোগ দেন। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে নজরুলের স্ত্রী প্রমিলা দেবী পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। স্ত্রী সুস্থ করতে নজরুলকে নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। স্ত্রীর অসুস্থতা ও যুদ্ধবিধবস্ত পৃথিবীর পরিমণ্ডল তাকে বিচলিত করেছিল। দিনে দিনে তার অস্থিরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে কোন এক অজানা আশংকা অনুভব করে কবি লিখেছিলেন-

যদি আর বাঁশি না বাজে, যদি তার সৃজনশীল ক্ষমতা হঠাৎ একদিন হারিয়ে যায়, 
তার বাঁশির সুর স্তব্দ হয়ে যায় তা হবে মৃত্যু নয়,
মৃত্যুর  চেয়েও ভয়ংকর। 

আগস্ট মাসে রবীন্দ্রনাথের তিরোধান দিবসে নজরুল তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখলেন- রবী হারা কবিতা।

বিশ্বের রবি, ভারতের কবি
শ্যাম বাংলার হৃদয়ের ছবি

১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে বেতারের এক অনুষ্ঠানের মাঝখানে কবি বাকরুদ্ধ হয়ে যান। ধীরে ধীরে তার চেতনা লুপ্ত হয়। আগুনের বাঁশি নিজে থেকে পুড়ে ছাই হয়ে যায় তাই হয়তো তার শেষ গানে লিখেছিলেন—

খেলা শেষ হলো, শেষ হয় নাই বেলা
কাঁদিও না কাঁদিও না তব তরে রেখে গেলু।

সত্যি সত্যি কবির বেলা শেষ হয়নি জীবনমৃত অবস্থায় কবি নজরুল আরো ৩৪ বছর বেঁচে ছিলেন যে অবস্থার কথা তিনি নিজে বলেছিলেন যা কিনা মৃত্যুর চেয়ে ভয়ংকর। ‘যদি আর বাঁশি না বাজে।’

আমি কবি বলে বলছি না, আমি আপনাদের ভালোবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারে বলছি আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন, আমায় ভুলে যাবেন।
দেশে-বিদেশে চিকিৎসা হলেও কোনো সুফল পাওয়া যায়নি ফলে কবির মানসিক ভারসাম্য সম্পূর্ণ হারিয়ে গিয়েছিল।

১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে ‘জগত্তারিণী’ স্বর্ণপদক প্রদান করে। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার তাকে পদ্মভূষণ খেতাব দিয়ে তাকে সম্মানিত করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এই স্বাধীনতা সংগ্রামে নজরুলের উদ্দীপন সঙ্গীত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উদ্ধুদ্ধ করেছিল তাই স্বাধীন বাংলাদেশ কবিকে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে নিয়ে আসে। বাংলাদেশ তাকে জাতীয় কবির মর্যাদার সঙ্গে নাগরিকত্ব প্রদান করে এবং একুশে পদক দিয়ে সম্মানিত করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে দ্বিতীয়বার ডি.লিট প্রদান করে। এ সম্মান যখন পেলেন তখন তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে গেছে। এমনি ভাগ্যের নির্মম পরিহাস।

তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি চাহিব না
কোলাহল করি সারাদিনমান কারো ধ্যান ভাঙ্গিব না
নিশ্চল নিশ্চুপ আপনার মনে পড়িব একাকী গন্ধ বিধূর ধুপ।

১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ১৯ শে আগস্ট তিনি ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বিশ্বের বিবেকবান মানবিক মানুষের হৃদয়ে ধারিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে সমাহিত করা হয়।

নজরুলের কণ্ঠস্বর মৃত্যুর আগেই স্তব্দ হয়ে গিয়েছিল কিন্তু জনমনে মোহিত বাণী তার গানে-কবিতায় তিনি রেখে গেছেন যা সারাবিশ্বের বাঙ্গালিদের কাছে আজও অম্লান হয়ে আছে, থাকবে এবং থাকবে...। 

আলোকিত রাঙামাটি