রাঙামাটি । বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ , ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নিউজ ডেস্কঃ-

প্রকাশিত: ০৯:৩৪, ১৭ মার্চ ২০২০

নিজের জন্মদিনে কী করতেন বঙ্গবন্ধু?

নিজের জন্মদিনে কী করতেন বঙ্গবন্ধু?

সংগৃহীত


‘আমি আমার জন্মদিন পালন করি না। যে জাতি অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটায়, কথায় কথায় গুলি করে হত্যা করা হয়, সে জাতির নেতা হিসেবে আমি জন্মদিন পালন করতে পারি না।’ এভাবেই সাংবাদিকদের বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর প্রতিজ্ঞা ছিল বাঙালি জাতির সার্বিক মুক্তি। বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য তিনি বার বার মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন। মৃত্যুর ভয়ে তিনি থেমে থাকেননি, বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে গেছেন।

আজ এই মহাকালের মহাপুরুষ বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। কখনো কী মনে হয়েছে এই মহাপুরুষ তার জন্মদিনে কী করতেন? কীভাবে পালন করতেন তার এ বিশেষ দিনটি?

২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৬ মার্চ পালিত হবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। কবি রফিক আজাদ বাংলার সবচেয়ে রূপবান পুরুষ হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে বর্ণনা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজের জন্মদিন কোনো দিন পালন করেননি। শেখ মুজিবুর রহমান তার কারাগারের রোজনামচা বইটিতে লিখেছিলেন, ‘আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। দিনটি ছিল ১৯৬৭ সালের ১৭ মার্চ।’

‘এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট্ট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনোদিন নিজে পালন করি নাই। বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটা উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনটিতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বোধ হয়, আমি জেলে বন্দি আছি বলেই। আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস! দেখে হাসলাম।’

এই জন্মদিনে সহবন্দীরাসহ দলের নেতারা বঙ্গবন্ধুকে গোলাপ, ডালিয়াসহ নানা ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। জন্মদিনের তিনদিন আগে স্ত্রী ও সন্তানরা তার সঙ্গে জেলগেটে দেখা করে গেছেন। ফলে এত অল্প সময়ের ব্যবধানে জন্মদিনে আবার দেখা হওয়ার সুযোগ হবে কিনা, সেই সংশয় ছিল জাতির পিতার মনে। তবে পরিবারের সদস্যরা আবারো আসবে বলে আত্মবিশ্বাসও ছিল তার।

অবশ্য ওইদিন তার আত্মবিশ্বাসেরই জয় হয়েছিল। জন্মদিনের দিন বিকেল পাঁচটার দিকে ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব কারাগারে তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। সঙ্গে একজনের দেয়া জন্মদিনের কেকও নিয়ে আসেন বেগম মুজিব। নিজের হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর মুক্ত জীবনের জন্মদিনগুলো ঘটা করে পালন না করলেও ১৯৬৭ সালের জন্মদিনটা কিছুটা আওয়াজ দিয়েই পালন করেছিল।

বঙ্গবন্ধুর মতে, জেলে থাকার কারণেই ওই বছর এমনটি হয়েছিল। এছাড়া ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগও বঙ্গবন্ধুর জন্য একটা বিরাট কেক ওইদিন পাঠিয়েছিল বলে ডায়েরিতে উল্লেখ করেন তিনি। ঢাকা আর চট্টগ্রামে বেশ ঘটা করেই উদযাপিত হয়েছিল শেখ মুজিবের জন্মদিন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তার বড় গুণ হলো দেশের মানুষকে তিনি বেশি ভালোবাসেন। আর তার দুর্বলতাও ছিল দেশের মানুষকে তিনি অনেক বেশি ভালোবাসেন।

রেসকোর্স ময়দানের ভাষণ শেষ করে তিনি বলেছিলেন, মনে আছে, আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করব! তিনি রক্ত দিয়েই মানুষের ভালোবাসার ঋণ শোধ করেছিলেন। পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময় জেলে কাটিয়েছেন। তিনি তার জীবনের চার হাজার ৬৮২ দিন জেলে কাটিয়েছেন। পাকিস্তান আমলের ২৪ বছরে প্রায় ১৮ বার জেলে যান। প্রায় ১৩ বছর বঙ্গবন্ধুকে জেলে কাটাতে হয়েছে। এসময় ৮টি জন্মদিন তার কেটেছে কারাগারে।

১৯৫০ সালে বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম তার জন্মদিন কারাগারে কাটান। তবে কারাগারের সঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রথম পরিচয় ১৯৩৮ সালে। তাও আবার হত্যা মামলার আসামি হিসেবে। যখন তিনি গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের ছাত্র।

বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, তার প্রথম গ্রেফতার হওয়ার কাহিনী। বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক গোপালগঞ্জ সফরে আসবেন। সঙ্গে থাকবেন শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তাদের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হবে। যার দায়িত্ব পড়ল শেখ মুজিবের ওপর। তিনি তার সমবয়সী হিন্দু, মুসলমান সবাইকে নিয়েই বেশ বড় একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করলেন। কদিন পরে দেখা গেল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী থেকে হিন্দু স্বেচ্ছাসেবকরা সবাই কেটে পড়ছে। জানা গেল, তাদের কংগ্রেস থেকে নিষেধ করা হয়েছে।

কারণ শেরেবাংলা ও সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার মন্ত্রী। সুতরাং তাদের সংবর্ধনা দেয়া যাবে না। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি হয় এবং রমাপদ দত্ত নামের একজন ছুরিকাহত হন। তখন শেখ মুজিব ও অন্য মুসলমান ছাত্রদের নামে হত্যা মামলা হয়। এতে শেখ মুজিবসহ অনেককে গ্রেফতার করা হয়। পরে অবশ্য সেই মামলা থেকে খালাস পান তিনি।  
 
১৯৫০ সালে ছিল বঙ্গবন্ধুর ৩১তম জন্মদিন। সেবছর ১ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে কারাগারে পাঠায়। টানা ৭৮৭ দিন কারাগারে কাটিয়ে ১৯৫২ সালে তিনি মুক্তি পান। এই দফায় বন্দীদশায় ১৯৫১ সালে তার ৩২তম জন্মদিনও কাটে জেলে। এরপর আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করলে ১৯৫৮ সালের ১১ অক্টোবর গ্রেফতার হয়ে টানা ১১৫৩ দিন বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে কাটাতে হয়।

গ্রেফতারের ১৪ মাসের মাথায় তিনি মুক্তি পেলেও সেদিনই কারা ফটকে আবারো গ্রেফতার হন তিনি। ১৯৫৯ সালে ৪০তম, ১৯৬০ সালে ৪১তম এবং পরের বছর ১৯৬১ সালের ৪২তম জন্মদিনও কাটে কারাগারের চার দেয়ালের ভেতর।

১৯৬১ সালের শেষ দিকে মুক্তি পাওয়ার কয়েক মাসের মাথায় ১৯৬২ সালের ৬ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু আবার গ্রেফতার হন। সে বছরের ১৮ জুন ছয় মাস ১২ দিন পর মুক্তি পান তিনি। তাই সে বছরে তার ৪৩তম জন্মদিন তাকে জেলে কাটাতে হয়। এরপর ১৯৬৭ সালে ৪৮তম এবং ১৯৬৮ সালে ৪৯তম জন্মদিনও বঙ্গবন্ধুর কাটে জেলখানায়।  

শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের বঙ্গ প্রদেশের অন্তর্ভূক্ত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। সেখানে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জ আদালতে সেরেস্তাদারের চাকরি করতেন। আর মা সায়েরা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। চার কন্যা এবং দুই পুত্রের সংসারে বঙ্গবন্ধু ছিলেন তৃতীয় সন্তান।

বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু একজনই জন্মেছিলেন। যার জন্ম না হলে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হতো না। এজন্য ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। তরুণ প্রজন্ম এই মহান নেতার আদর্শ থেকেই দেশ গড়ার অনুপ্রেরণা লাভ করে।

সূত্র: ‘কারাগারের রোজনামচা’

আলোকিত রাঙামাটি

জনপ্রিয়