রাঙামাটি । বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ , ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নিউজ ডেস্কঃ-

প্রকাশিত: ১২:২৪, ৭ নভেম্বর ২০২০

পাগলী বলে পাননি আশ্রয়, তবুও আয়ের টাকা দান করেন মসজিদ-এতিমখানায়

পাগলী বলে পাননি আশ্রয়, তবুও আয়ের টাকা দান করেন মসজিদ-এতিমখানায়

দীল আফরোজ খুকি


সংবাদপত্র বিক্রি করে জীবন কাটাচ্ছেন দীল আফরোজ খুকি। প্রায় ৪০ বছর ধরে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হেঁটে রাজশাহী নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সংবাদপত্র বিক্রি করেন তিনি। শহরের একমাত্র নারী সংবাদপত্র বিক্রেতাও তিনি।

কিশোরী বয়সে ৭০ বছরের এক বৃদ্ধের সঙ্গে খুকির বিয়ে হয়েছিল। মাস যেতে না যেতেই স্বামী মারা যান। ১৯৮০ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর পরিবার আত্মীয় স্বজন তাকে গৃহ ছাড়া করেন। ভাইদের আপত্তিতে বাবার বাড়িতেো তার জায়গা হয়নি তার। এরপর থেকেই কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি। পাগলী বলে তাকে কেউ আশ্রয়ও দেয় না। এমনকি অনেকে মারধরও করে। তবুও কারো দয়ার পাত্রী না হয়ে বেছে নেন সংবাদপত্র বিক্রির পেশা।

বড় কোনো সমস্যা তাকে কাবু করতে না পারলেও মাঝমধ্যে ছোটখাটো সমস্যাগুলো তাকে অসহায় করে দেয়। এরপরো কোনো লোভ-লালসা নেই খুকির। একদিন মানিব্যাগ ফিরিয়ে দিয়ে মালিকের কাছ থেকে ১৫০ টাকা বকশিস পান খুকি। পুরো রাজশাহীর মানুষকে সেদিন বলেছেন, আমি সবার চেয়ে ধনী। আমার কাছে ১৫০ টাকা আছে। তোমাদের কারো কাছে এতো টাকা আছে? 

খুকি জানান, স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকসহ প্রতিদিন ৩০০ পত্রিকা তিনি বিক্রি করেন। এ থেকে প্রতিদিন তার আয় ৩০০ টাকা। এই টাকা থেকে কিছু নিজের খরচ মাত্র ৪০ টাকা। বাকি টাকা থেকে ১০০ টাকা দেন একটি এতিমখানায়, ৫০ টাকা মসজিদ-মন্দিরে, ১০ টাকা ভিক্ষুকদের আর হজে যাওয়ার জন্য ১০০ টাকা একটি ব্যাংকে রাখেন।

প্রতিদিন সকালে তার শিরোইল মহল্লার বাসা থেকে বের হয়ে হেঁটে রাজশাহী মহানগরীর রেলগেট মার্কেটে পত্রিকার এজেন্টদের কাছ থেকে পত্রিকা ক্রয় করেন। তারপর সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে রাজশাহীর রেলস্টেশন, শিরোইল বাস টার্মিনাল, সাগরপাড়া, আলুপট্টি, সাহেব বাজার, আরডিএ মার্কেট ও নিউ মার্কেটে পত্রিকা বিক্রি করেন। এইসব স্থানে তার কিছু নিয়মিত কাস্টমার আছে তাদের কাছে পত্রিকা বিক্রি করেন আবার সড়কে চলাচলকৃত বা বাজারে কেনাবেচা করতে আসা মানুষদের কাছে নিয়ে গিয়েও পত্রিকা কিনতে অনুরোধ করেন। এদের মধ্যে অনেকে পত্রিকা নেন আবার অনেকে পত্রিকা নেন না। তবে পত্রিকা বিক্রির বিনিময়ে তিনি কখনো অতিরিক্ত কোনো টাকা পয়সা নেন না।

দিল আফরোজ বলেন, আগে বেশি পত্রিকা বিক্রি হতো। লোকজনের কাছে গেলে পত্রিকা নিতো। এখন কম পত্রিকা বিক্রি হয়। লোকজন তেমন পত্রিকা কিনতে চায় না।’ তারপরও আমৃত্য এই পেশার সাথে থেকেই জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চান তিনি।

পত্রিকার ক্রয় করার সময় এজেন্টদের সঙ্গে তার লেনদেনও ভালো। টাকাপয়সা কখনো বকেয়া রাখেন না বলে জানালেন পত্রিকার এজেন্টরা। দাম পরিশোধ করেই তিনি পত্রিকা ক্রয় করেন।

রাজশাহীর স্থানীয় দৈনিক সানশাইনের সার্কুলেশন ম্যানেজার লিটন ইসলাম বাবু জানান, আমি ১৩ বছর ধরে খুকি আপাকে দেখছি আমার কাছ থেকে পত্রিকা নিতে। কখনো কোনো বকেয়া রাখেন নি তিনি। আগে টাকা পরিশোধ করে তারপর পত্রিকা কিনেন। দুই তিন বছর আগেও সানশাইন পত্রিকা নিতো একশো কপির মতো। এখন কখনো তিরিশ কপি কখনো ২০ কপি নেন।

রাজশাহীর আরেকটি স্থানীয় দৈনিক সোনালী সংবাদের সার্কুলেশন ম্যানেজার হারুণও জানালেন টাকা পয়সা পরিশোধ করেই তারপর পত্রিকা কিনেন খুকি। তার পত্রিকাও আগে দেড়শো কপির মতো কিনলেও বর্তমানে ৩০ থেকে ৫০ কপির মতো কিনেন বলেন জানান তিনি।

রাজশাহী হকার্স শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি জামিউল করিম সুজন জানান, আমি ২০০০ সালে পত্রিকা বিক্রির সাথে যুক্ত হই। তখন থেকেই খুকি আপাকে দেখছি পত্রিকা কিনে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতে।

তবে খুকির পরিচিত আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশিরা বলছেন, কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন এই নিঃসন্তান নারী। তার স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে আরো একগুয়ে স্বভাবের হয়ে উঠেন তিনি। বাবার কাছ থেকে পাওয়া জমিতে বাড়ি তৈরি করে একাই থাকেন। কারো কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা নেন না। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে পত্রিকা বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করেন।

একই মহল্লার সত্তরোর্ধ্ব আব্দুল কাদির বলেন, আমার ছোট বোনের বান্ধবী খুকি। বিয়ের পর স্বামী মারা যাবার পর থেকেই সে কিছুটা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তারপর থেকে তাকে পত্রিকা বিক্রি করতে দেখি। আমিও তার নিয়মিত গ্রাহক। প্রতিদিন সকালে আমাকে পত্রিকা দিয়ে যায়।

দিল আফরোজের বড় বোনের বাড়ি তার বাড়ির পাশেই। তার বড় বোনের ছেলে শামস উর রহমান বলেন, খালা বহুবছর ধরে পত্রিকা বিক্রির সঙ্গে জড়িত। তাকে নিষেধ করা হলেও শুনেন না। কতোজনের কাছ থেকে যে তার খালা পত্রিকা বিক্রির টাকা পাবে তার হিসেব নেই।

আলোকিত রাঙামাটি

জনপ্রিয়