রাঙামাটি । শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ , ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নিউজ ডেস্কঃ-

প্রকাশিত: ১৪:৩৬, ১৩ জুলাই ২০২০

বোরোয় এবার ফলন বেড়েছে, বিক্রিতেও লাভবান কৃষক

বোরোয় এবার ফলন বেড়েছে, বিক্রিতেও লাভবান কৃষক

 

  • বিআইজিডির গবেষণা রিপোর্ট অসঙ্গতিপূর্ণ বিভ্রান্তিকর: ব্রি

     

এ বছর বোরো আবাদে গত বছরের তুলনায় কৃষকের ৪০ শতাংশ বেশি লাভ হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে লাভ হয়েছে তারও বেশি। গত বছর যেখানে বোরোতে ধানের দাম ছিল মণপ্রতি ৫৫০ টাকা সেখানে এবার সারাদেশে ৭০০ থেকে ৯৫০ টাকা দরে প্রতিমণ ধান বিক্রি হয়েছে। ধানের যা দাম পেয়েছেন তাতে কৃষকরা বেশ সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)। এ বছর

আবহাওয়া ধান চাষের অনুকূলে থাকায় বোরো ধানের ফলন অঞ্চলভেদে ৪-৭ শতাংশ এবং মোট উৎপাদন প্রায় ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ফলন কম নয় বরং বেড়েছে বলেও মনে করে সংস্থাটি।

সম্প্রতি ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গবর্ন্যান্স এ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয় করোনায় বোরোয় কৃষকের লাভ কমেছে ৪০ শতাংশ। শতকরা ৯৯ জন কৃষককেই তাদের ধান সরকার নির্ধারিত ১০৪০ টাকা মণের চেয়ে কম দরে বিক্রি করতে হয়েছে। ২ হাজার ৮৩৪ জন বোরো কৃষকের ওপর পরিচালিত গবেষণাটি একটি ওয়েবিনারে প্রকাশ করেন বিআইজিডি’র সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নারায়ণ দাস। গবেষণায় বলা হয়, কৃষকরা করোনাকালে শ্রমিক সঙ্কট, পণ্য পরিবহন ও আর্থিক টানাপড়েনের মতো সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। বোরো ধান নিয়ে বিআইজিডি’র জরিপ অসঙ্গতিপূর্ণ এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য রয়েছে বলেও জানায় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। ব্রি’ পাঠানো এক তথ্যে আরও জানা গেছে, এ বছর মোট উৎপাদন প্রায় ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সারা বিশ্ব যখন করোনা মহামারী উত্তর খাদ্য সঙ্কটের আশঙ্কা করছে ঠিক তখন বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে আশাতীত সাফল্য দেখিয়েছে। দেশে অব্যাহতভাবে চালের উৎপাদন বাড়ছে।

এবার বোরো ধান ঠিকমত ঘরে তোলা গেছে, সেই সঙ্গে ধান বিক্রি করে কৃষকরা ভাল দাম পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক। কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, আমরা সব সময় চাই ধান-চালের দাম এমন একটা অবস্থায় থাকবে যাতে কৃষকও খুশি থাকবে। সঙ্গে সঙ্গে যারা নিম্ন আয়ের মানুষ তারাও একটা যুক্তিসঙ্গত দামের ভিত্তিতে তাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে। এবছর কৃষক দামের দিক দিয়ে বেশ খুশি ছিল।

বিআইজিডি’র জরিপ নিয়ে কৃষিমন্ত্রী জনকণ্ঠকে বলেন, এ ধরনের গবেষণায় কৃষি বিজ্ঞানীদের অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। এটি হাইলি টেকনিক্যাল বিষয়। তারা বলছে, সার দিতে পারে নাই, পানি দিতে পারে নাই। যখন করোনা শুরু হয়েছে তখন সার দেয়ার সময় ছিল না যা দেয়ার আগেই দিয়েছে। গবেষণাকে অভিনন্দন জানাই তবে আমরা অনুরোধ করব এ ধরনের গবেষণায় বিজ্ঞানীদের যেন অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

জানা গেছে, বোরো মৌসুমে উত্তরের খাদ্যভান্ডার জেলাসহ দেশের কয়েক জেলার তথ্য নিয়ে জানা যায় খোলা বাজার ও হাটগুলোতে বোরো ধানের দাম ভাল পেয়েছে কৃষক। কোথাও কোথাও বাজারে দাম বেশি হওয়ায় সরকারী খাদ্যগুদামে ধান দেয়নি লটারিতে নির্বাচিত কৃষকরা। যদিও করোনায় বোরো কৃষকের লাভ কমেছে বলছে বিআইজিডি গবেষণা প্রতিবেদন। বিআইজিডি’র প্রকাশিত প্রতিবেদন নিয়ে ব্রি’র মতামত তুলে ধরে বলেন, এটি একটি র্যােপিড টেলিফোনিক জরিপ। এই ধরনের র্যা পিড জরিপের ফলাফল দিয়ে দেশের খাদ্য উৎপাদনের মতো একটি সংবেদনশীল বিষয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। বারবার করোনার কথা বলে কৃষকদের লিডিং প্রশ্নের মাধ্যমে উত্তরকে প্রভাবিত করা হয়েছে যা মানসম্মত জরিপের ক্ষেত্রে অগ্রহণযোগ্য। জরিপের সময়সীমা নিয়ে ব্রি মতামতে বলেন, ২০ মে থেকে ৩ জুন পর্যন্ত সময়সীমায় জরিপে দেখানো হয়েছে ৭২ ভাগ কৃষক জরিপ শুরুর আগেই ধান কাটা শেষ করেছেন। বাকি ২৮ ভাগ কৃষক মে মাসের ২০ তারিখেও ধান কাটা শেষ করতে পারেনি, স্পষ্টত এসব কৃষক লেট বা নাবী বোরো চাষী। বাংলাদেশের মাত্র ৫ শতাংশ জমিতে নাবী বোরো চাষ হয় যা সারাদেশের বোরো আবাদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব করে না। ফলে, গবেষণার জন্য কৃষক নির্বাচনে এই পক্ষপাতিত্ব গবেষণার ফলাফলকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ব্রি জানায়, তাদের উপস্থাপনায় বলা হয়েছে, সারাদেশে কৃষকের প্রত্যাশার চেয়ে ফলন কমেছে একরপ্রতি ৪.০২ মণ (৭ শতাংশ) এবং এতে করে দেশে মোট উৎপাদন কমেছে ৪.৮২ কোটি মণ বা প্রায় ১৯ লক্ষ ২৮ হাজার টন (১০ শতাংশ)। কিন্তু ব্রি করোনাকালীন সময়ে যথাক্রমে ১৪টি কৃষি অঞ্চলে ধানের উৎপাদন, মজুদ ও দামের অবস্থা, হাওড় অঞ্চলে বোরো ধানের কর্তন পরিস্থিতি, ১৪টি কৃষি অঞ্চলে ১০৪৮টি কৃষকের মাঠে ফসল কর্তন এবং দক্ষিণে আমফানের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব সংক্রান্ত চারটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। উক্ত গবেষণায় দেখা গেছে, এ বছর আবহাওয়া ধান চাষের অনুকূলে থাকায় বোরো ধানের ফলন অঞ্চলভেদে ৪-৭ শতাংশ এবং মোট উৎপাদন প্রায় ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং বিআইজিডির প্রাপ্ত ৭ শতাংশ ফলন হ্রাসের তথ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

ফলন হ্রাসের কারণ হিসেবে গবেষণায় করোনার প্রভাবজনিত সমস্যা যেমন- সময়মতো সার, কীটনাশক ও সেচ দিতে না পারার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সার নিয়ে ব্রি জানান, যে সব ধান ১০ জুনের মধ্যে কাটা হয়েছে তার সার প্রয়োগের সময় ১ এপ্রিলেই শেষ হয়েছে। সেক্ষেত্রে করোনার প্রভাবে সার প্রয়োগ না করার কারণে ফলন কমার তথ্য যুক্তিসঙ্গত নয়। তাছাড়া সার পাওয়া যায়নি বা সারের সঙ্কট হয়েছে এ ধরনের তথ্য কোন গণমাধ্যম বা সারাদেশে আমাদের মনিটরিং টিমের কাছে প্রতীয়মান হয়নি। এমনকি করোনামহামারীর এই সময়ে চলমান আউশের ক্ষেত্রেও কোন সার সঙ্কট বা অপ্রতুলতার তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

পেস্টিসাইড সঙ্কট বা না দেয়ার কারণে উৎপাদন কম হয়েছে তা শুধু বিভ্রান্তিকরই নয়, এবছর বোরোতে সারাদেশে কোথাও রোগবালাই আক্রমণের কারণে ফসলহানি হয়েছে এই ধরনের কোন রেকর্ড নেই। শুধুমাত্র কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিচ্ছিন্ন কিছু এলাকায় ব্লাস্টের আক্রমণ ছাড়া সারাদেশে কোথাও রোগ-বালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণের খবর পাওয়া যায়নি। তাই ফসলহানির কোন কারণ নেই। ডিজেল বা বিদ্যুতের অভাব সারা মৌসুমে কোথাও পরিলক্ষিত হয়নি। ব্রি’র ১৫টি মনিটরিং টিম, ডিএই’র মাঠ পর্যায়ের সকল কর্মকর্তা এবং মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ সারাদেশে সার্বক্ষণিকভাবে মনিটরিং করেছেন একটি নিরাপদ ও রেকর্ড উৎপাদনের প্রত্যাশায়। যেখানে সারা মৌসুমে কোন ধরনের সমস্যা প্রতীয়মান হয়নি সেখানে করোনার কারণ দেখিয়ে উৎপাদন হ্রাসের প্রদত্তচিত্র বাস্তব সম্মত নয়। এছাড়া পরিবহন সমস্যার কারণে উৎপাদন খরচে প্রভাব পড়েছে বলে উল্লেখ করা হলেও বাস্তবে গ্রামীণ জনপদে লকডাউনের প্রভাব ছিল না বললেই চলে। কৃষক নিয়মিত মাঠ পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম ছিলেন এবং স্থানীয় পর্যায়ে যানচলাচলও স্বাভাবিক ছিল।

ব্রি জানায়, কৃষকদের ধান কাটার আগেই ফলন, দাম ও লাভজনক তার অনুমান নির্ভর কল্পনা করতে বলা হয়েছিল। কল্পনার ওপর লাভ-ক্ষতি হিসাব করা বাস্তবসম্মত নয়। ধান চাষে প্রয়োজনীয় প্রতিটি ইনপুটের আর্থিক মূল্যমান ও মাঠে প্রয়োগকৃত পরিমাণ এবং উৎপাদিত ফসলের বিদ্যমান বাজারমূল্য বিবেচনায় নিয়ে ব্রি পরিচালিত ‘প্রফিট্যাবিলিটি এনালাইসিস’ থেকে জানা যায় কৃষকের এবার গত বছরের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি লাভ হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে লাভ হয়েছে তারও বেশি। গত বছর যেখানে বোরোতে ধানের দাম ছিল মণপ্রতি ৫৫০ টাকা সেখানে এবার কৃষিবিভাগের ১৪টি অঞ্চল ও জেলার কৃষিসম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালকদের পাঠানো তথ্যানুসারে সারা দেশে ৭০০ থেকে ৯৫০ টাকা দরে প্রতিমণ ধান বিক্রি হয়েছে। যা গত বারের বোরোর তুলনায় অনেক বেশি এবং এবার ধানের যা দাম পেয়েছেন তাতে কৃষকরা বেশ সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। ফলে বোরো আবাদে লাভ ৪০ ভাগ কম হয়েছে বলা বিভ্রান্তিকর বলে মনে করে ব্রি। এছাড়াও শ্রমিক সঙ্কটের কারণে ক্ষতি বৃদ্ধির বিষয়টিও সঠিক নয়। বোরোর কর্তন মৌসুমে অন্যান্য বছরের তুলনায় শ্রমিকের প্রাপ্যতা সহজলভ্য ছিল। কেননা এক দিকে লকডাউনের কারণে শহর ফেরত অকৃষি শ্রমিকরা নিজ নিজ গ্রামে বোরো কর্তনে অংশ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে কৃষিমন্ত্রীর নেতৃত্বে কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সরকারের পুরো প্রশাসন কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে এক ধরনের উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি হওয়ায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষও ঝাঁপিয়ে পড়েন বছরের সবচেয়ে বড় ফসল বোরো ধান ঘরে তুলতে। সরকারের যান্ত্রিক সহযোগিতায় হাওড়সহ সারাদেশের ধান কাটায় এক নতুনমাত্রা যোগ করেছে। কম্বাইন হারভেস্টার ও রিপার দিয়ে মহাধুমধামেই কৃষকরা ঘরে তুলছেন তাদের সোনালি ফসল।

ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বলছেন, সারাবিশ্ব যখন করোনা মহামারী উত্তর খাদ্য সঙ্কটের আশঙ্কা করছে ঠিক তখন বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে আশাতীত সাফল্য দেখিয়েছে। দেশে অব্যাহতভাবে চালের উৎপাদন বাড়ছে। মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) এর তথ্য মতে ধারাবাহিকভাবে ২০০৯ সাল থেকে ৬ লক্ষ টন হারে উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে চাল উৎপাদনে তৃতীয় বৃহত্তম দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিগত আউশ, আমন ও চলতি বোরোর আশাতীত ফলন হওয়ায় প্রকৃতপক্ষে এবছর চালের উৎপাদন হবে মোট ৩ কোটি ৮৫ লাখ টন। এ বছরের উদ্বৃত্ত উৎপাদন এবং বিগত বছরের মজুদে আগামী ৮ মাস আমাদের খাদ্যের কোন সমস্যা হবে না। তাই ধান উৎপাদনের মতো একটি ‘হাইলি টেকনিক্যাল’ বিষয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞ অন্তর্ভুক্ত করা হলে আলোচনা আরো সমৃদ্ধ হতো এবং বিতর্কের সৃষ্টি হতো না বলেও জানান ব্রি। ব্রি মনে করে, সারা দেশে যেখানে বোরোর ফলন কম হওয়ার কোন দৃশ্যমান কারণ বা যৌক্তিকতা পরিলক্ষিত হয়নি সেখানে ধানের মতো অত্যন্ত সংবেদনশীল পণ্যের ওপর এরূপ বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করে দেশে চাল আমদানির ক্ষেত্র তৈরি করে কৃষক এবং দাম বাড়িয়ে ভোক্তা তথা দেশের মানুষকে ক্ষতির মধ্যে ফেলা মোটেও সমীচীন নয়। এছাড়াও এ ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার না করতে এবং বিভ্রান্ত না হতে সকলকে অনুরোধও জানান বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট।

আলোকিত রাঙামাটি