রাঙামাটি । শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ , ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নিউজ ডেস্কঃ-

প্রকাশিত: ১৩:০২, ২৬ ডিসেম্বর ২০২০

রিমোট মনিটরিং সিস্টেমে দেশের ৯৬ থানা

রিমোট মনিটরিং সিস্টেমে দেশের ৯৬ থানা

গাজীপুরের কালীগঞ্জ থানা। ফাইল ছবি


ডিউটি অফিসারের কক্ষ, হাজতখানা এবং সেন্ট্রিবক্স। এই তিনটি স্থানকে ঘিরেই আবর্তিত হয় থানার মূল কার্যক্রম। অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং দায়িত্বে অবহেলাসহ দীর্ঘদিন ধরে নানা অভিযোগ এসব স্থানকে কেন্দ্র করেই।

ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের কঠোর মনিটরিংয়ের পরও এসব স্থানে ঘটছে অপেশাদার ঘটনা। তাই এবার থানাগুলোকে আনা হচ্ছে রিমোট মনিটরিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের আওতায়। পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ১৩টি জেলার ৯৬টি থানায় এরই মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে এ কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। 

আগামী ১ জানুয়ারি থেকে এটা পুরোপুরি কার্যকর করা হবে। পর্যায়ক্রমে এ রেঞ্জের সবকটি জেলা সদর, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি সৌধ, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, চারটি ফেরিঘাট এবং মহাসড়কের রোড জংশন, বিভিন্ন জাতীয় দিবস এবং ধর্মীয় উৎসবসহ বিভিন্ন কর্মসূচি এর আওতায় আসবে।

ঢাকা রেঞ্জের সফলতার ভিত্তিতে দেশের অন্য থানাগুলোতেও এ পদ্ধতি চালু হবে। থানা মনিটরিংয়ে বাংলাদেশে এ ধরনের সিস্টেম এটাই প্রথম। একেবারে নতুন এ প্রযুক্তিতে চমকে যাচ্ছেন পুলিশ সদস্যরাও। পুলিশের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

সূত্র জানায়, থানাগুলোকে রিমোট মনিটরিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের আওতায় আনার জন্য ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজির কার্যালয়ে বসানো হয়েছে অপারেশন্স কন্ট্রোল অ্যান্ড মনিটরিং সেন্টার।

এ সেন্টার থেকে উন্নত প্রযুক্তির সহায়তায় ২৪ ঘণ্টা মনিটরিং করা হচ্ছে থানাগুলোকে। থানার ডিউটি অফিসার, হাজতখানা এবং সেন্ট্রিবক্সে বসানো আছে নাইট ভিশন মাল্টিকালার আইপি ক্যামেরা।

এসব ক্যামেরার ফুটেজ সরাসরি দেখা যাচ্ছে অপারেশন্স কন্ট্রোল অ্যান্ড মনিটরিং সেন্টার থেকে। সেখান থেকেই ক্যামেরা ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে আশপাশের দৃশ্যও দেখতে পাচ্ছে রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়।

যখনই কোনো থানার কার্যক্রমে অসঙ্গতি চোখে পড়ছে তখনই তার স্ক্রিন শট নিয়ে নেয়া হচ্ছে। 

হিকভিশন ব্র্যান্ডের ইজেটভিআইজেট ক্যামেরার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্য এবং সেবাপ্রার্থীর সঙ্গে লাইভ কথা বলছেন সেন্টারের কর্মকর্তারা। সেন্টারে কর্মরত কর্মকর্তারা কথা বলার পাশপাশি থানার লাইভ ভিডিও দেখতে পেলেও থানার পুলিশ সদস্যরা কোনো ভিডিও ফুটেজ দেখতে পান না।

তাই কোনো অসামঞ্জস্য দেখে যখন রেঞ্জ অফিস থেকে কথা বলা হচ্ছে তখন অনেক ক্ষেত্রেই চমকে উঠছেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যরা। প্রাথমিকভাবে অনেকেই বুঝতে পারছে না কোথা থেকে আওয়াজ আসছে।

কোনো কোনো পুলিশ সদস্য মনে করছেন তার পাশে থাকা ওয়্যারলেস সেট থেকেই বুঝি কথা বলা হচ্ছে। তখন ওই পুলিশ সদস্যকে বলা হয়- ‘আপনি সিসি ক্যামেরার দিকে তাকান।

আমি রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয় থেকে বলছি।’ তখন আকস্মিক পরিস্থিতি সামলে ওই পুলিশ সদস্য বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। পরে ঘটনার গুরুত্ব অনুযায়ী বিষয়টি সংশ্লিষ্ট থানার ওসি বা জেলার এসপিকে জানানো হচ্ছে। পাশাপাশি নেয়া হচ্ছে যথাযথ ব্যবস্থা। 

শরীয়তপুর ভেদরগঞ্জ থানার ডিউটি অফিসারের কক্ষ। ১৭ ডিসেম্বর দীর্ঘ সময় এখানে কোনো পুলিশ সদস্য দায়িত্বে ছিলেন না। চেয়ার ছিল ফাঁকা। টেবিলে কিছু জিনিসপত্র ছিল।

এ দৃশ্যটি ওইদিন দুপুর ১২টা ৬ মিনিট ২৯ সেকেন্ডে স্ক্রিন শট নিয়ে রেখে দেয় ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ের অপারেশন্স কন্ট্রোল অ্যান্ড মনিটরিং সেন্টার। 

গাজীপুরের কালীগঞ্জ থানার ডিউটি অফিসারের কক্ষ মাঝেমধ্যেই থাকে পুরোপুরি ফাঁকা। ২৩ ডিসেম্বর দুপুর ১২ টা ১ মিনিটে এ সংক্রান্ত একটি স্ক্রিন শট নেয়া হয়।

পুলিশের পোশাক পরা ছাড়াই ঢাকার নবাবগঞ্জ থানায় ডিউটি পালন করেন কোনো কোনো পুলিশ সদস্য। ৩০ নভেম্বর এ সংক্রান্ত একটি স্ক্রিন শট নেয়া হয়। এতে দেখা যায়, সাদা পোশাকে ডিউটি পালন করছেন এক পুলিশ সদস্য।

২১ ডিসেম্বর দীর্ঘসময় ফাঁকা ছিল টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানার ডিউটি অফিসারের কক্ষ। ওইদিন দুপুর ১২টা ৪১ মিনিট ২৪ সেকেন্ড এ সংক্রান্ত একটি স্ক্রিন শট নেয়া হয়।

২৪ নভেম্বর মুন্সীগঞ্জ সদর থানায় আসা সেবাপ্রার্থীদের দ্রুত সেবা দেয়ার ব্যবস্থা না করে দীর্ঘ সময় মোবাইল ফোনে ব্যস্ত ছিলেন ডিউটি অফিসার। নাইট ভিশন মাল্টিকালার আইপি ক্যামেরায় ধরা পড়ে সে দৃশ্য।

ওইদিন সন্ধ্যা ৬টা ৫৯ মিনিট ৪২ সেকেন্ডে এর স্ক্রিন শট নেয়া হয়। সবকটি ঘটনাতেই সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের তিরস্কার করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করে দেয়া হয়েছে রেঞ্জ ডিআইজি অফিসের সংশ্লিষ্ট সূত্র যুগান্তরকে এমন তথ্য জানিয়েছে।

সূত্রটি আরও জানায়, যেহেতু প্রকল্পটি এখনও পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আছে সেজন্য প্রাথমিক পর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়লেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। তবে ১ জানুয়ারির পর থেকে কঠোর হবে ডিআইজি কার্যালয়। 

জানতে চাইলে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান আইজিপির ভিশন অনুযায়ী, পুলিশই হবে জনগণের প্রথম ভরসার স্থল।

তার পাঁচটি মূলনীতির মধ্যে তিনটি হল- দুর্নীতিমুক্ত পুলিশি সেবা, নিপীড়ন ও হয়রানিমুক্ত পুলিশি সেবা এবং পুলিশের বৃহত্তর কল্যাণ, শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতা বাস্তবায়ন।

অপারেশন্স কন্ট্রোল অ্যান্ড মনিটরিং সেন্টারের মাধ্যমেই এই তিনটি মূলনীতি পুরোপুরি মনিটরিং সম্ভব। প্রত্যেক থানার ৩০ দিনের ভিডিও রেকর্ড সংরক্ষিত থাকবে সেন্টারে। ক্যামেরাগুলোতে জুম ক্যাপাসিটি আছে।

এর মাধ্যমে ছবি বা ভিডিওকে কাছে এনে বড় করে দেখা যায়। তিনি বলেন, আমরা যে প্রযুক্তিটি চালু করেছি সেটি বাংলাদেশ পুলিশের আধুনিকায়নে বিস্ময়কর সাফল্য। 

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশের সেবা দানের মূল কেন্দ্র হল থানা। তাই পুলিশের সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে মনিটরিংয়ের বিকল্প নেই।

থানায় আসা সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে ভদ্র আচরণ করতে আইজিপির সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। রিমোট মনিটরিং সিস্টেমের মাধ্যমে এ বিষয়টিও নিশ্চিত করা যাবে। 

পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি আসাদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, থানার ডিউটি অফিসারের বিরুদ্ধে আমাদের কাছে প্রায়ই নানা ধরনের অভিযোগ আসে।

কোনো কোনো সময় অভিযোগ আসে- আটক বা গ্রেফতারের পর হাজতখানায় আসামিদের নির্যাতন করা হয়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করার বিধান থাকলেও কয়েকদিন ধরে হাজতখানায় আটকে রাখা হয় বলেও অভিযোগ আসে।

তাছাড়া সেন্ট্রির বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনে অবহেলা, দুর্ব্যবহার ও ক্ষেত্র বিশেষে আসামি বা তার স্বজনদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার অভিযোগ আসে। তাই এই তিনটি জায়গা সরাসরি রেঞ্জ ডিআইজি অফিস থেকে মনিটরিং করা হচ্ছে।

কোনো থানার ওসি, সার্কেল এসপি বা জেলার এসপি যদি এ মনিটরিং কার্যক্রমে যোগ দিতে চায় তাহলে অবশ্যই তাকে ডিআইজি কার্যালয়ের অনুমতি নিতে হবে। 

তিনি আরও বলেন, মনিটরিং সেন্টারে একজন ইন্সপেক্টর, একজন এসআই এবং দু’জন কনস্টেবল সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করবেন। কোনো অসঙ্গতি দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবেন।

অর্গানুগ্রাম অনুযায়ী, অতিরিক্ত ডিআইজির (অপস অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স) তদারকি করবেন। শিটফ ইনচার্জ প্রতি শিফট শেষে অতিরিক্ত ডিআইজির কাছে লিখিত প্রতিবেদন দাখিল করবেন।

কোনো থানার ডিউটি অফিসার, হাজতখানা এবং সেন্ট্রি পোস্টের ক্যামেরা বন্ধ থাকলে তার কারণ নির্ণয় করে তাৎক্ষণিকভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবেন শিফট ইনচার্জ। 

জানতে চাইলে অতিরিক্ত ডিআইজি (অপস অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স) নুরেআলম মিনা যুগান্তরকে বলেন, সেবাপ্রত্যাশীদের জন্য ডিউটি অফিসারের কক্ষে চকোলেট, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ফোন নম্বর লেখা কার্ড এবং জিডির ফরম আছে কিনা তা নতুন সিস্টেমে ভালোভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে।

সেবাপ্রার্থীরা কত সময় থানায় বসে আছেন, সেবাপ্রার্থীদের প্রতি ডিউটি অফিসারের সাড়া কেমন, যথাযথ ড্রেসরুল অনুযায়ী অফিসার-ফোর্স-সেন্ট্রি ইউনিফর্মে আছেন কিনা, ডিউটি অফিসারের কক্ষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আছে কিনা ইত্যাদি বিষয় মনিটরিং করা হচ্ছে কন্ট্রোল রুম থেকে।

এছাড়া বীর মুক্তিযোদ্ধা, বয়স্ক নারী ও শিশুদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে কিনা, ডিউটি অফিসারের কক্ষে একই লোক বারবার আসছে কিনা, একসঙ্গে অনেক লোক আসছে কিনা, সেন্ট্রি দু’জন (একজন থানার মূল গেটে ও অন্যজন হাজতখানার সামনে) আছেন কিনা, সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে সেন্ট্রির আচরণ, সেন্ট্রি রাতে কলাপসিবল গেটে তালা দিয়ে ভেতরে বসে আছেন কিনা ইত্যাদি বিষয় মনিটরিং করা হয়।

এছাড়া প্রতিদিন ভোরে এবং রাত ১০টার পর হাজতিদের বিষয়ে তথ্য নেয়া, হাজতখানায় কোনো অস্বাভাবিক বিষয় দেখা যায় কিনা- নারী হাজতি থাকলে নারী সেন্ট্রি আছে কিনা, কোনো হাজতিকে কোর্টে পাঠানো না হলে তা নোট রাখা, হাজতখানা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সেখানে শীতকালীন কম্বল আছে কিনা, হাজতখানায় আসামিদের আত্মীয়স্বজন খাবার দিচ্ছে কিনা, হাজতির সঙ্গে অস্বাভাবিক উপকরণ (গামচা, রশি, শাড়ি, লুঙ্গি, মোবাইল ফোন) আছে কিনা, হাজতিদের আচরণ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করা হয় মনিটরিং সেন্টার থেকে।

সূত্রঃ যুগান্তর

আলোকিত রাঙামাটি