রাঙামাটি । মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪ , ৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১০:০৯, ২৭ মে ২০২১

হারিয়ে যাওয়ার ১৩ বছর পর মা-বাবাকে ফিরে পেল হাসনা বানু

হারিয়ে যাওয়ার ১৩ বছর পর মা-বাবাকে ফিরে পেল হাসনা বানু
ছবিঃ হারিয়ে যাওয়া হাসনা বানু ও তার পরিবার

ওমর ফারুক মুছা, লংগদু প্রতিনিধিঃ- সময়টা ২০০৮ সালের জুলাই মাসের কোন এক তারিখে স্বজনদের হারিয়ে চট্টগ্রামের রাউজানের ব্যস্ততম সড়কের এক পাশে দাঁড়িয়ে কাদছে ৮ বছরের শিশু হাসনা বানু। 

রাউজানের এক সহৃদয় ব্যক্তি সে সময় হাসনা বানু কে দেখতে পেয়ে তিনি তার বাড়িতে নিয়ে যান। পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে ২০০৮ সালের ১২ই আগস্ট হাসনা বানুর ঠিকানা হয় তৎকালীন চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারিতে কর্মরত অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার মাহবুবুল হাসান এর পরিবারে। ২০০৮ সাল থেকেই নিজের মেয়ের মতোই তিনি লালন পালন করতে থাকেন হাসনা বানুকে। মাহবুবুল হাসান ২০১৯ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েটি এখন বিবাহযোগ্য যুবতি।

হাসনা বানুকে সুপাত্রের হাতে তুলে দিতে এবছর প্রস্তুতি শুরু করেন মাহবুবুল হাসান। এক্ষেত্রে বিয়ের রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে প্রয়োজন জন্ম নিবন্ধন সনদ এবং এনআইডির নাম্বার ও আসল পিতা মাতাকে। মেয়েটির এনআইডি কিংবা জন্ম নিবন্ধন সনদ তৈরি করতে শুক্রবার দুপুরে (২১ মে, ২০২১) প্রয়োজনীয় পরামর্শ করেন তার অগ্রজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রির স্বনামধন্য অধ্যাপক ডঃ মোঃ মোজাফফর হোসাইন এর সাথে। অধ্যাপক ডঃ মোঃ মোজাফফর হোসাইন তাৎক্ষণিকভাবে তার প্রাক্তন ছাত্র সত্যজিতকে ফোন দেন। সত্যজিত রায় দাশ কর্মরত আছেন হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিজ শিক্ষকের কাছ থেকে হাসনা বানুর বিবরণ জেনে তার পিতা মাতাকে খুঁজে বের করার উদ্যোগ নেন ইউএনও সত্যজিত। 

মাত্র আট বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট হাসনা বানু তার স্মৃতিতে পিতা এবং মাতার নাম ব্যতীত অন্য কোন তথ্যাদি মনে রাখতে পারেনি। কেবলমাত্র এই দুটি নাম দিয়ে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের মধ্যে থেকে তার পিতা-মাতাকে খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব বিষয়।

এক্ষেত্রে সত্যজিত সহযোগিতা নেন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজপ্রতিম বেদারুল ইসলামের। তিনি কর্মরত আছেন উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে টেকনাফে। বেদারুল ইসলামকে জাতীয় তথ্য ভাণ্ডার থেকে মেয়েটির পিতা-মাতাকে খুঁজে বের করার একটি কার্যকর প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে অনুরোধ জানান ইউএনও সত্যজিত। বেদারুল জাতীয় তথ্য ভান্ডার থেকে কেবলমাত্র মেয়েটির পিতা ও মাতার নাম দিয়ে অনুসন্ধান করে শতশত নামের মধ্যে থেকে কাঙ্খিত পরিবারটিকে খুঁজে বের করার প্রয়াস চালান। বিশাল ডাটাবেজ থেকে হাসনা বানুর পিতা-মাতাকে শনাক্ত করতে ট্রায়াল এন্ড এরর পদ্ধতি অনুসরণ করেন তিনি।

শুক্রবার রাত সাড়ে এগারোটায় রাঙামাটি লংগদু উপজেলা মাইনীমুখ ইউনিয়নের সোনাই এলাকায় দুই বোনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয় যাদের পিতা-মাতার নামের সাথে হাসনা বানুর দেয়া বিবরণ এর আশ্চর্য মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বেদারুল রাতেই বিষয়টি ইউএনও সত্যজিতকে অবহিত করেন। তাৎক্ষণিকভাবেই সত্যজিত তার ব্যাচমেট লংগদুর ইউএনও মাইনুল আবেদীন মাসুদের নজরে আনেন এবং তাকে এই পরিবারটির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যাদি অনুসন্ধানের জন্য অনুরোধ করেন।

লংগদু ইউএনও মাইনুল আবেদিন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যের সহায়তায় পরিবারটির তথ্যাদি সংগ্রহ করেন এবং তাদের একটি কন্যাসন্তান রাউজানে হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

হাসনা বানু পরিবারকে রাঙামাটির লংগদুতে খুঁজে পাওয়ার বিষয়টি মেয়েটির আশ্রয়দাতা মাহবুবুল হাসান এবং তার অগ্রজ অধ্যাপক ডঃ মোঃ মোজাফফর হোসাইনকে নিশ্চিত করলে তাদের পরিবারে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। হাসনা বানু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকেন তার পিতা-মাতাকে একনজর দেখার জন্য।

গত রবিবার সকালে লংগদুর ইউএনও মাইনুল আবেদিন মাসুদের ডাকে সাড়া দিয়ে তার কার্যালয়ে স্বশরীরে উপস্থিত হন হাসনা বানুর পিতা মজিবুর রহমান এবং মাতা ফরিদা বেগম। ইউএনও সত্যজিত মেয়েটিকে এবং তার পিতা-মাতাকে ভিডিও কলে সংযুক্ত করেন।

এ সময় ভিডিও কলে যুক্ত ছিলেন মেয়েটির আশ্রয়দাতা মাহবুবুল হাসান, অধ্যাপক ড. মোঃ মোজাফফর হোসাইন, ইউএনও লংগদু মঈনুল আবেদীন মাসুদ, বাহুবল ইউএনও স্নিগ্ধা তালুকদার, টেকনাফ উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা  বেদারুল ইসলাম। দীর্ঘ ১৩ বছর পরে হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে ফিরে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন হাসনা বানুর পিতা মাতা। হাসনা বানুর চোখে জল গড়িয়ে পড়ে অঝোর ধারায়। তাদের আবেগঘন মিলন দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ভিডিও কলে সংযুক্ত অন্য সকলেও।

কেবলমাত্র সরকারের তথ্যভাণ্ডারের উপর নির্ভর করে দীর্ঘ ১৩ বছর হাসনা বানু ফিরে পায় তার পিতা-মাতাকে। মাত্র ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে বাংলাদেশ এর জাতীয় তথ্য ভান্ডার ১৩ বছর পূর্বে হারিয়ে যাওয়া হাসনা বানুকে ফিরিয়ে দিয়েছে তার পিতা-মাতার কাছে। হাসনা বানুর পিতা মাতা ডিজিটাল বাংলাদেশের কল্যাণে এবং সরকারি কর্মচারীদের কর্মনিষ্ঠা ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় ফিরে পেলেন ৮ বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া তার অত্যন্ত আদরের মেয়েটিকে।

কোটি মানুষের আশা এবং আকাঙ্ক্ষা পূরণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ এক ঝাঁক নিবেদিত প্রাণ সরকারি কর্মচারীদের নিয়ে প্রতিদিন তৈরি করছে এমন অসংখ্য অনুপ্রেরণাদায়ী গল্প।

আলোকিত রাঙামাটি

সর্বশেষ

জনপ্রিয়